তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের দাপট নিরঙ্কুশ। প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা দীর্ঘদিন দেশটির দখলে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাজার হিস্যার দিক থেকেও বড় ব্যবধানে এগিয়ে চীন। ভিয়েতনাম দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতায় এ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। অতিমারি করোনার কবলে পড়ে গত বছর ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা খোয়া যায় বাংলাদেশের। তবে পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশের অনুকূলে। এ দুই দেশ থেকে রপ্তানি আদেশ এখন বাংলাদেশে সরিয়ে নিয়ে আসছে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা। এ কারণে বাংলাদেশে এখন তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশের ঢল। ছোট-বড় কিংবা ঠিকা কাজের কারখানা (সাব-কন্ট্রাক্ট) সবখানেই দিনরাত কাজ। কাজের চাপে দুই শিফটে উৎপাদন করছে কোনো কোনো কারখানা।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসে রপ্তানি আদেশ আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। পরিমাণে মোট ৩৭৫ কোটি ডলার। আগের বছরের একই মাসে রপ্তানি আদেশ ছিল ২৩০ কোটি ডলার। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আদেশ বেড়েছে ৩২ শতাংশ। মোট ২৬৩ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেছে মাসটিতে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হওয়ায় অন্যান্য মাসের তুলনায় অন্তত দুই দিনের উৎপাদন এবং রপ্তানি কম হয়ে থাকে। এ কারণে রপ্তানি আদেশও অন্যান্য মাসের তুলনায় কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শেষে উৎপাদন এবং চূড়ান্ত রপ্তানিতে কমবেশি তিন মাস সময়ের প্রয়োজন। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির রপ্তানি আদেশের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে আগামী এপ্রিলের রপ্তানি প্রতিবেদনে।
প্রবণতা বিশ্নেষণে দেখা যায়, গত বছরের এপ্রিল থেকেই করোনার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশের রপ্তানি খাত। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই আগের মাসের চেয়ে রপ্তানি বাড়ছে। ডিসেম্বরে রেকর্ড ৪০৪ কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি। জানুয়ারিতে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৯ কোটি ডলারে। ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানির পরিমাণ ৩৫১ কোটি ডলার। মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে রপ্তানি আগের একই সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে ৫২ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, মোট ১৬৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ১০১ কোটি ডলারের পোশাক।
জানতে চাইলে লায়লা স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর পরিচালক ইমরানুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে রপ্তানি আদেশ পাচ্ছেন তারা। চীনের সঙ্গে দেশটির বৈরী সম্পর্ক এবং শুল্ক্ক লাড়াইয়ের কারণে মার্কিন ক্রেতারা চীনের প্রতি বিমুখ। অনেক ক্রেতাই চীন থেকে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কমপ্লায়েন্ট কর্মপরিবেশের সুবিধাও এতে যোগ হয়েছে। তার আশা, আগামীতে রপ্তানি আদেশ বাড়বে।
শোরুমে সময়মতো পণ্য ওঠাতে কোনো রকম ঝুঁকিতে যেতে চায় না ব্র্যান্ড-ক্রেতারা। এ কারণে কয়েকটি দেশে রপ্তানি আদেশ ভাগ করে দেওয়া হয়। যেমন- অনেক ব্র্যান্ড ক্রেতা বাংলাদেশকেও রপ্তানি আদেশ দেয়, আবার একই সঙ্গে চীনকেও দেয়। এ রকম ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি আদেশ বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাড়তি এ রপ্তানি আদেশ চীন-ভিয়েতনাম থেকেই সরিয়ে আনা হয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। কারণ, দেশ দুটি একাধিক কারণে উৎপাদন সংকটে পড়েছে।
চীন থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে আনার অন্য কারণ হিসেবে চীনের উৎপাদনশীলতা কমে আসার কথা বলেছেন মিথিলা টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আজহার খান। তিনি বলেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে চীন সপ্তাহে তিন দিন উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে চীনের উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কমেছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকে চীনের লাল চিহ্নিত কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার শত শত কারখানা এখন বন্ধ। এ কারণে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা চীন থেকে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে এখন বাংলাদেশমুখী। তার কারখানায় রপ্তানি আদেশ এখন দ্বিগুণ। অনেক রপ্তানি আদেশ ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।
ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি আদেশ সরানোর কারণ প্রসঙ্গে অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল হক মুকুল জানান, যে কারণে চীনকে এড়িয়ে চলছে মার্কিন ক্রেতারা তা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও কিছুটা খাটে। কারণ, নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় চীনা উদ্যোক্তাদের কারখানাই বেশি ভিয়েতনামে। এ ছাড়া ভিয়েতনামেরও সক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এসব কারণে ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে বাংলাদেশে দিচ্ছেন ক্রেতারা।
তিনি বলেন, সরাসরি একটি ব্র্যান্ড ভিয়েতনামে কারখানা খুলতে অনুরোধ করেছে তাকে। কিছু নতুন ক্রেতাও আসছে সম্প্রতি। এরা চীন এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে আগে কাজ করত। কিছু ক্রেতা তিন দেশেই আগে রপ্তানি আদেশ দিত। এখন ওই ক্রেতারা এখানে দ্বিগুণ রপ্তানি আদেশ দিচ্ছেন।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর সর্বশেষ ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব পোশাক বাজারে চীনের অংশ ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের অংশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।