করোনাকালের শুরুতে ২০২০ সালে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি কমে গেলেও ২০২১ সালের শেষে তা আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে। তবে শঙ্কার বিষয়, এই একই সময়ে চতুর্থ ধাপে প্রসবের আগে তা কমে ৪৭ শতাংশে নেমেছে। করোনাকালে বাড়িতে প্রসবের প্রবণতা বাড়ার কারণে প্রসূতি মায়েরা হাসপাতালে যেতে কম আগ্রহী। এ কারণে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে বাড়িতে ৫০ শতাংশ প্রসূতি মায়ের প্রসব হচ্ছে। এসব প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছেন ৩১ শতাংশ প্রসূতি মা, আগে যা ছিল ২২ শতাংশ। এর পরই মৃত্যুর আরেক বড় কারণ খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া। এ কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়, যা আগে ছিল ২০ শতাংশ। অর্থাৎ করোনাকালে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু বেড়েছে। স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সার্ভে (এসভিআরএস) এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে শনিবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে’। দেশব্যাপী বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষ সুবিধাসহ সরকারি ও বেসরকারিভাবে দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিলম্বিত প্রসব (অবস্টেট্রিক লেবার) ও সেপটিক অ্যাবরশন বাড়িতে করার ফলে ইনফেকশন হয়ে অনেক মা মারা যাচ্ছেন। আর দেশে মাত্র ৫৩ শতাংশ প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে প্রসব করানো হচ্ছে।
অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘প্রসূতি মায়ের জন্য হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট নেই, যেখানে মাল্টিডিসিপ্লিনারি ট্রিটমেন্ট হয়। যে ইউনিটে হেমাটোলজিস্ট, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ থাকবে, সার্বক্ষণিক নার্স চেকআপে থাকবে। দেশের কোনো হাসপাতালে এ ধরনের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট নেই। করোনায় আক্রান্তের পর গর্ভধারণের আগে অবশ্যই একটি চেকআপ প্রয়োজন। কারণ করোনার কারণে কিডনি, রক্ত জমাট বাঁধা, লিভারসহ নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-শিশু ও মায়ের যত্নে চিকিৎসা) ও লাইন ডিরেক্টর (এমসি-আরইএইচ) ডা. মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘গ্রাম এলাকায় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ৫০ শতাংশ প্রসূতি মাকে বাড়িতেই প্রসব করানোর চেষ্টা হয়। এতে রক্তক্ষরণ বেশি হয়। আমরা চেষ্টা করছি ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ গর্ভবতী মাকে প্রসবকালে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে। ’
২০২০ সালের সর্বশেষ হিসাবে দেশে প্রসবকালে প্রতি লাখে মারা যাচ্ছেন ১৬৩ জন প্রসূতি মা। আর করোনাকালে বাড়িতে প্রসব বেশি হওয়ায় এই মৃত্যু আরেকটু বেড়েছে। সচেতনতা ও অপেক্ষাকৃত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় শহর এলাকায় প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া অনেক সহজে মোকাবেলা করা যায়, যেটা গ্রামাঞ্চলে সম্ভব হয় না। আর দক্ষ প্রসবকর্মী বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসব না করানোর ফলে বেশির ভাগ মা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। করোনার লকডাউনে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিতে না পারায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণও বেড়ে গেছে। মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটি আরেকটি কারণ।