মুঠোফোন কিংবা প্রসাধন—এসব পণ্যের ক্ষেত্রে বিদেশিটাতেই বেশি আগ্রহ মানুষের। তবে মুরগির বেলায় দেশিটা না হলেই যেন চলে না। সেটা বুঝেই বোধ হয় বগুড়ার শেরপুরের উদ্যোক্তারা দেশি মুরগি চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। প্রতি রাতেই খাঁচিবোঝাই দেশি মুরগি নিয়ে বগুড়ার শেরপুর থেকে ঢাকার পানে ছোটে অসংখ্য ছোট ট্রাক। শেরপুরে যা হচ্ছে সেটিকে ‘দেশি মুরগির বিপ্লব’ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় লোকজন। আর এ বিপ্লবের পেছনে রয়েছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন মো. রায়হান।
ইচ্ছা আর উদ্যোগ থাকলে একজন ব্যক্তিই যে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারেন, তাই দেখিয়ে দিয়েছেন রায়হান। গত পাঁচ বছরে রায়হানের উদ্যোগ ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি’ সারা দেশে ছড়িয়েছে। বগুড়ার শেরপুরেই সহস্রাধিক তরুণ–তরুণী ওই কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে নিজেদের জীবিকার পথ করে নিয়েছেন আর দেশি মুরগিকে বাঙালির পাতে ফিরিয়েছেন। স্বপ্ন ছোঁয়া এসব উদ্যোক্তার খামারে এখন কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের। এসব খামারে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড (হরমোন) ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। অর্গানিক পদ্ধতিতে এসব খামারে প্রতি মাসে উৎপাদন হচ্ছে চার হাজার কেজি দেশি মুরগির মাংস ও ১ লাখ ৩০ হাজার ডিম। দেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য শেরপুর উপজেলায় এখন ৯টি হ্যাচারি হয়েছে। এসব হ্যাচারিতে মাসে গড়ে ৮৫ হাজার দেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে।
দেশি মুরগির জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ এবং স্বল্প বিনিয়োগে উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান ও জনসেবায় অনবদ্য ভূমিকা রাখায় মো. রায়হান ইতিমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে (ব্যক্তিগত শ্রেণি) জনপ্রশাসন পদক পেয়েছেন। জেলা ও রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবায় শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী কর্মকর্তার স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। মো. রায়হানের উদ্যোগে অভিভূত হয়ে ‘স্বপ্ন ছোঁয়া সিঁড়ি’ নামের উদ্যোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ২০টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়েছে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (সমন্বয় ও সংস্কার)।
মো. রায়হান ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে আগে কর্মরত ছিলেন ভোলার মনপুরা উপজেলায়। ওই দ্বীপজেলায় মানুষের ঘরে পোষা মুরগিই প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস। বগুড়ার শেরপুরে বদলি হয়ে আসার পর দেখেন এখানে প্রচুর সোনালি ও ব্রয়লার মুরগি বাণিজ্যিক খামার আছে। হাটে-বাজারে সবখানেই বিদেশি মুরগির ছড়াছড়ি। কিন্তু দেশি মুরগি পাওয়াই যেত না। তখনই তাঁর মাথায় দেশি মুরগির খামারের চিন্তা আসে।
মো. রায়হান বলেন, ২০১৫ সালে শেরপুরে আসার পর জানতে পারেন স্থানীয় আমজাদ হোসেন, আবদুল কাদের ও এনামুল হক তাদের বাড়িতে সনাতন পদ্ধতিতে ৫০-৬০টি করে দেশি মুরগি পালেন। তিনজনকে ডেকে আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির খামার করার কথা বলেন, প্রশিক্ষণ দেন। অল্প দিনেই সফল হন তাঁরা। তাঁদের সফলতার কথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। অনেকেই প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর আগ্রহী ১৫ জন তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া হয়। তাঁদের নিয়ে দেশি মুরগির বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের এ উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি। অল্প দিনে তারাও সফল হন। দেশজুড়ে এ উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শেরপুর শহরের টাউন কলোনি এবং গাড়িদহ ইউনিয়নের চকপাথালিয়া গ্রামে দুটি ‘উদ্যোক্তা পাঠশালা’ চালু করা হয়েছে। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার সারা দেশ থেকে আসা ৩০ জন উদ্যোক্তাকে দেশি মুরগির বাণিজ্যিক খামারে পালন, অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়ড ব্যবহার না করেই দ্রুত সময়ে অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদন, বাজারজাতকরণের নানা কৌশল শেখানো হয় এই পাঠশালায়।
দেশি মুরগির চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি । কয়েকবছর আগেও দেশি মুরগির বাণিজ্যিক খামার ছিল না। এখন শুধু বগুড়া জেলাতেই প্রায় এক হাজার ২০০ দেশি মুরগির খামার হয়েছে।
রফিকুল ইসলাম তালুকদার, বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা
এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শেরপুরের ধড়মোকাম গ্রামের জাকারিয়া ইসলাম (২২) এখন সফল খামারির খেতাব পেয়েছেন। তিনি এখন সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয় তাঁর। বাবার তেমন কিছুই নেই। তাই পড়ার খরচ চালাতে ঋণ করে ছয় হাজার টাকা জুটিয়ে ৪০টি বাচ্চা দিয়ে দেশি মুরগি পালন শুরু করেন। পাঁচ বছর পরে এখন জাকারিয়ার খামারে দেশি জাতের ডিম পাড়া (প্যারেন্টস) মুরগির সংখ্যা পাঁচ শর ওপরে। একসঙ্গে ৩৭ হাজার দেশি মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য রয়েছে নিজস্ব হ্যাচারি। বাড়িতে মোটাতাজাকরণের ছয়টি গরু আছে। পড়াশোনাও চলছে, এখন গড়ে প্রতি মাসে জাকারিয়ার আয় প্রায় অর্ধ লাখ টাকা।
স্বপ্ন ছোয়াঁ সিঁড়ির উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও লেনদেনের কারণে ব্যবসা সহজতর হয়েছে। সাধারণ খামারিরা হ্যাচারি মালিকদের কাছে ডিম সরবরাহ করেন। অতিরিক্ত বাচ্চা হ্যাচারি থেকেই কিনে নেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তা পাঠশালায় প্রশিক্ষণ শেষে সারা দেশ থেকে আসা আগ্রহী উদ্যোক্তারাও স্বপ্ন ছোঁয়া সিড়ি থেকেই বাচ্চা নেন। একটি বাচ্চার দাম নেওয়া হয় ২০ টাকা। তবে ডিমের দাম ওঠানামা করলে বাচ্চার দামও কমবেশি হয়। খামারিদের ডাক পেলেই ছুটে যান গবাদিপশু চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত ১২ জন ‘স্বপ্ন বন্ধু’।
বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশি মুরগির চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি । কয়েকবছর আগেও দেশি মুরগির বাণিজ্যিক খামার ছিল না। এখন শুধু বগুড়া জেলাতেই প্রায় এক হাজার ২০০ দেশি মুরগির খামার হয়েছে।