দাম্পত্য জীবন মধুময় করতে যেসব আমল করবেন

দাম্পত্য জীবন আল্লাহর এক বিশেষ রহমত— যেখানে দুটি হৃদয় একসঙ্গে পথ চলে; কিন্তু প্রতিটি সম্পর্কই মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়, ভুল বোঝাবুঝি জন্মায়, দূরত্ব তৈরি হয়। তখন শুধু কথায় সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার শক্তি আসে না; আসে আমল, দোয়া, সহনশীলতা এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাধ্যমে। ইসলাম দাম্পত্য বন্ধনকে শুধু সামাজিক চুক্তি হিসেবে দেখেনি; বরং এটিকে ইবাদত, মহব্বত, রহমত ও শান্তির এক অপূর্ব মিলন হিসেবে দেখেছে। তাই দাম্পত্য জীবন মধুময় রাখতে ইসলাম কিছু হৃদয়ছোঁয়া আমল শিখিয়েছে— যা শুধু ঝগড়া থামায় না, বরং সম্পর্কের ভেতর বরকত, ভালোবাসা এবং আত্মিক শান্তি এনে দেয়।

দাম্পত্য জীবন মধুময় করতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল

১. একসঙ্গে দোয়া করা (স্বামী-স্ত্রীর জন্য)

নবীরা তাদের পরিবারকে নিয়ে দোয়া করতেন। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মাঝে ভালোবাসা বাড়িয়ে দেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) এভাবে দোয়া করেছেন—

رَبِّ اجۡعَلۡنِیۡ مُقِیۡمَ الصَّلٰوۃِ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ ٭ۖ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلۡ دُعَآءِ

‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও আর আমার পরিবারকেও, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমার প্রার্থনা কবূল কর।’ (সুরা ইবরাহিম: আয়াত ৪০)

২. দুজনে মিলেই নিয়মিত সালাত আদায় করা

ঘরে নামাজ পড়া—ঘরে নূরের বরকত বাড়ায়, দাম্পত্য জীবনে প্রশান্তি আনে। যে দম্পতি একসাথে নামাজ পড়ে, তাদের মাঝে রহমত নেমে আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَّ اجۡعَلُوۡا بُیُوۡتَكُمۡ قِبۡلَۃً وَّ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ

‘আর তোমাদের ঘরগুলোকে ইবাদাত গৃহ কর, আর নামাজ প্রতিষ্ঠা কর এবং মুমিনদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৮৭)

৩. হাসিমুখে কথা বলা

একটি শক্তিশালী সুন্নাহ হচ্চে হাসি মুখে কথা বলা। পরস্পরের জন্য হাসি সদকা, স্ত্রী বা স্বামীর জন্য তা আরও বড় সদকা ও রহমত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ

‘তোমার মুখের হাসি—তোমার ভাইয়ের জন্য সদকা।’ (তিরমিজি ১৯৫৬)

৪. প্রতিদিন ভালো কথা

মানুষের সঙ্গে ভালো কথা বলতে কুরআনে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে দাম্পত্য জীবনে ভালো কথা বলা অবশ্যই অপরিহার্য। স্বামী-স্ত্রীর মধুর কথা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন—

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

‘আর মানুষের সাথে উত্তম কথা বলো ‘ (সুরা বাকারা: আয়াত ৮৩)

৫. রাগ দমন ও ক্ষমা করা

রাগ দাম্পত্য শান্তিকে নষ্ট করে। স্বামী-স্ত্রী যদি রাগ দমন শিখে নেয়, বরকত কখনই ঘর ছাড়বে না। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَ الۡكٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

‘আর যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৩৪)

 

৬. স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করা

দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা, সম্মান ও কোমল আচরণ হলো সুখী সম্পর্কের ভিত্তি। স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়—বরং মহান সুন্নাহ, যা মানুষকে উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতায় পৌঁছে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي

‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি ৩৮৯৫)

৭. স্ত্রীর প্রতি নরম ব্যবহার করা

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের নরম ব্যবহার হলো দাম্পত্য জীবনের মধুরতার মূল। অন্য এক হাদিসে এসেছে—

فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا 

‘অতএব, তোমাদের অসিয়ত করা হলো নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার জন্য।’ (বুখারি ৫১৮৬)

৮. পরস্পরকে হালালভাবে সময় দেওয়া

পোশাক যেমন শরীর ঢেকে রাখে, রক্ষা করে, উষ্ণতা দেয়—তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য শান্তি ও আচ্ছাদন। কুরআনে আল্লাহ বলেন—

هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ

‘তোমরা তাদের জন্য পোশাক এবং তারা তোমাদের জন্য পোশাক।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৭)

৯. অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করা

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

إِذَا أَحَبَّ أَحَدُكُمْ صَاحِبَهُ فَلْيُخْبِرْهُ

‘তোমাদের কেউ তার সঙ্গীকে ভালোবাসলে তাকে তা জানিয়ে দাও।’ (মুসনাদ আহমাদ, ২১৫৮৪)

দাম্পত্য জীবনকে মধুময় করার জন্য কোনো জটিল কাজের প্রয়োজন নেই— প্রয়োজন কোমলতা, সুন্নাহর অনুসরণ, পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। যে ঘরে নামাজ, দোয়া, হাসিমুখ, ক্ষমা আর ভালোবাসা রয়েছে— সেখানে ঝগড়া থাকতে পারে, কিন্তু শয়তানের জায়গা থাকে না। আল্লাহ প্রতিটি দাম্পত্য জীবনে বরকত, শান্তি ও ভালোবাসা দান করুন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে করুন রহমত, দৃঢ়বন্ধন ও প্রশান্তির কেন্দ্রস্থল। আল্লাহুম্মা আমিন।