সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দক্ষিণ আফ্রিকার ডিজিটাল ব্যাংক “টাইম ব্যাংক” ২০১৯ সাল থেকেই ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভরভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। ব্যাংকটির মূল উদ্দেশ্য ছিল মাত্র ৫ মিনিটের ভেতর ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেয়া ও অন্যান্য দ্রুতগতি ভিত্তিক পরিষেবা প্রদান করা এমন সব গ্রাহকদের জন্য যারা ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষদের জন্য।
ডিজিটাল ব্যাংকগুলি সাধারণত স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে তাদের পরিষেবা প্রদান করে। শাখা ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের পরিবর্তে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবহার করে কম খরচে কাজ করছে।
তবে টাইম ব্যাংকেয়ের ব্যবসায়িক মডেল ‘ফিজিটাল’ ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই মডেলে অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন এবং রিটেইল পার্টনারশিপের মাধ্যমে গ্রাহকরা সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলতে, টাকা জমা বা উত্তোলন করতে এবং দৈনন্দিন লেনদেন পরিচালনা করতে পারে।
তারা পিক এন পে, বক্সার এবং টিএফজির মত সুপারমার্কেট চেইনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছে, যাদের দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ৫৭৬৮টির মত দোকান রয়েছে। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে, তার গ্রাহকদের জন্য টাইম ব্যাংক ১,০০০টিরও বেশি কিয়স্ক এবং ১৫,০০০টিরও বেশি রিটেইল পয়েন্ট সংযুক্ত করছে, যেখানে গ্রাহকরা সহজেই ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
ব্যাংকটির ‘এভরিডে’ অ্যাকাউন্ট গ্রাহকদের মাসিক ফি ছাড়া লেনদেনের সুবিধা দেয়, আর ‘গোলসেইভ’ সেভিংস ফিচারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের নির্দিষ্ট সেভিংস লক্ষ্য স্থির করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী মুনাফা আয় করতে পারে। ‘সেন্ডমানি’ সুবিধার মাধ্যমে দ্রুত টাকা প্রেরণ ও গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও, ‘মোরটাইম’ প্রোডাক্টটি গ্রাহকদের বাই নাও পে লেটার (অর্থাৎ এখন কিনুন, কিন্তু টাকা পরে প্রদান করুন) সুবিধা দেয়, যা বিশেষভাবে ছোট ব্যবসা এবং দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য কার্যকর। ব্যাংকটির ভিসা ডেবিট কার্ড, কিয়স্ক ও পিক এন পে, বক্সারের মতো রিটেইল পার্টনারশিপ ব্যবহার করে নগদ লেনদেন ও সরাসরি অ্যাকাউন্ট কার্যক্রমকে আরও সহজ করে তুলেছে। পিক এন পে স্টোর ব্যবহার করে লেনদেন করলে রিওয়ার্ড পয়েন্ট এবং ডাবল রিওয়ার্ড পয়েন্ট সুবিধা পাওয়া যায়। কিছু অতিরিক্ত ঋণ-সেবা এবং ওভারড্রাফট সুবিধা ভবিষ্যতে চালু হওয়ার পথে রয়েছে।
সম্প্রতি তারা সিরিজ-ডি তহবিল রাউন্ডে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। যার মধ্যে ব্রাজিলের নুব্যাংক ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এমএন্ডজির ক্যাটালিস্ট ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাকি ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করেছে টাইম গ্রুপের বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডাররা। আমরা জানি ব্রাজিলের নুব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফল ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর একটি, যারা টাইম ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছে আরো ভালো ডেটা বিশ্লেষণ, ক্রেডিট ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পণ্য উন্নয়ন এবং বিপণনের মত ক্ষেত্রে গতি আনার প্রয়াসে। এছাড়া তাদের চীনা ইন্টারনেট জায়ান্ট টেনসেন্ট হোল্ডিংসেরও বিনিয়োগ রয়েছে।
বর্তমানে টাইম ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা ১০.১০ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি প্রায় ৪০২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য আমানত সংগ্রহ করছে। আর ৮০,০০০ এর বেশি ক্ষুদ্র গ্রাহককে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমতুল্য পরিমাণ ঋণ প্রদান করেছে (অর্থাৎ গড়ে বাংলাদেশি টাকায় প্রত্যেকটি গ্রাহককে ৯ লক্ষ টাকার মতো ঋণ প্রদান করেছে)। এটি আফ্রিকার প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে ২০২৩ সালে লাভের মুখ দেখেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, এটির মূল্যায়ন দাঁড়িয়েছে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ব্যাংকটিকে ‘ইউনিকর্ন’ স্ট্যাটাস দিয়েছে।
টাইম ব্যাংক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিপাইনে পরিচালিত হচ্ছে। গত ৩ বছরেরও কম সময়ে তারা ফিলিপাইনে ৬.৫ মিলিয়ন গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। ২০২২ সালে তাদের গ্রুপ সদর দপ্তর সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরিত করে এবং সেই বছরই ফিলিপাইনে ‘গোকংওয়ে’ গ্রুপের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে “গো টাইম ব্যাংক” চালু করে। ফিলিপাইনের গ্রাহকরাও দক্ষিণ আফ্রিকার মত গোকংওয়ে অনুমোদিত সুপারমার্কেট এবং অন্যান্য চেইন শপে অর্থ জমা এবং উত্তোলন করতে পারেন। ফিলিপাইন ইতিমধ্যে ৬টি ডিজিটাল ব্যাংককে লাইসেন্স দিয়েছে এবং আরো ৪টি যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডিজিটাল ব্যাংকগুলি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, যেখানে ডিজিটাল ঋণ বার্ষিক ২০% এরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রযুক্তি কোম্পানি ‘গোটু’ এবং সিঙ্গাপুরের ‘গ্র্যাব’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনা করছে। জাপানের ‘এয়ন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’ গত বছর মালয়েশিয়ায় একটি ইসলামী ডিজিটাল ব্যাংক খুলেছে। সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা ‘টেমাসেক হোল্ডিংস’, ‘গুগল’ এবং ‘বেইন অ্যান্ড কোম্পানি’র মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬টি প্রধান দেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্স ঋণের পরিমাণ ২০২২ সালে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে, এই সংখ্যাটি ২০০ থেকে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তাই টাইম ব্যাংক তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা অনুসারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। প্রথম পর্যায়ে তারা মার্চেন্ট ক্যাশ অ্যাডভান্স ও এসএমই ঋণ সুবিধা প্রদান করবে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেবে। পরবর্তীতে পুরো ব্যাংকিং পরিষেবা চালু করা হবে, যেখানে সেভিংস, লেনদেন এবং অন্যান্য ঋণ সুবিধাসহ পুরো ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। এই সম্প্রসারণ টাইম ব্যাংকের জন্য শুধু ব্যবসায়িক আওতা বৃদ্ধি নয়, বরং নতুন বাজারে ডিজিটাল ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলার সুযোগও তৈরি করবে।
টাইম ব্যাংকের শক্তি হলো তাদের প্রযুক্তি-ভিত্তিক, সহজ এবং কম খরচের সেবা প্রদান করা। এই মডেলটি গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকিংকে সহজ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছে। তবে নতুন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধা, স্থানীয় আইন ও লাইসেন্স প্রক্রিয়া, ঋণ ঝুঁকি এবং স্থানীয় গ্রাহকদের সঙ্গে কার্যকরভাবে সংযোগ স্থাপন করা। এছাড়াও, অন্যান্য ডিজিটাল ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতা ও স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাদের পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
তাদের এই সম্প্রসারণ কৌশল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিনটেক বাজারে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। যদি তারা সঠিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, স্থানীয় নিয়ন্ত্রক ও বাজার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবে তাদের ব্যবসায়িক মডেল দ্রুত গ্রাহক আকর্ষণ এবং লাভজনকতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। টাইম ব্যাংক প্রমাণ করেছে যে ডিজিটাল ব্যাংকিং শুধুমাত্র সুবিধা প্রদান নয়, এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে।
তবে মনে রাখতে হবে উন্নত দেশ বা প্রযুক্তি থাকলেই যে তারা সফল হবে এমন কোন কথা নেই। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়া ৪টি ডিজিটাল ব্যাংককে অনুমোদন দিলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়িক অর্থায়নে বিশেষজ্ঞ হিসেবে মাত্র ১টি ডিজিটাল ব্যাংক ব্যাংক এখন অবশিষ্ট রয়েছে!
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এই দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। এই অঞ্চলে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেশি হলেও, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেমন: বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৮০% প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার কাছে স্মার্টফোন ছিল, কিন্তু মাত্র ৫৬% গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। তারপরেও ৩টি সর্বাধিক জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে ডিজিটাল ঋণ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে, যেহেতু তাদের ছোট ব্যবসাগুলো দ্রুত ডিজিটালাইজড হচ্ছে এবং সেই সুযোগে এমবেডেড ও মার্চেন্ট ঋণ মডেল ভালো কাজ করছে।