‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯২১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এই প্রতিষ্ঠানের। তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত বাংলায় এটিই ছিল একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরাধীন দেশে এবং রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ১৬ মাস ধরে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে এমন দিনেও আজ জাঁকজমকপূর্ণ কোনো কর্মসূচি আয়োজন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সীমিত পরিসরে প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে শতবর্ষ পূর্তির মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে অগ্রবর্তী অনুষ্ঠান।
আগামী নভেম্বর মাসে শতবর্ষের আনুষ্ঠানিকতা উদযাপনের সিদ্ধান্ত আছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনলগ্নে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। পাশাপাশি অভিনন্দন জানিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে। তিনি বলেন, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান।
দেশের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ ও চিরকৃতজ্ঞ চিত্তই এগিয়ে চলার পাথেয়। তাই শতবর্ষে মাতৃভূমি ও গণমানুষের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা। শতবর্ষ উদ্্যাপনের বিরল সৌভাগ্য-প্রাপ্তির ক্ষণে আমরা দেশের শিক্ষা ও গবেষণার মানকে আরও উন্নত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। পাশাপাশি চলমান মহামারি পরিস্থিতি উত্তরণ হলে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, সর্বোপরি ক্যাম্পাস আগের মতো প্রাণবন্ত ও মুখরিত হবে সেই প্রার্থনা করি।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা জানান, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত মান বজায় রাখার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি অভিধা পেয়েছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে। পাশাপাশি এটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালুর ২৬ বছরের মধ্যে ব্রিটিশদের কবল থেকে উপমহাদেশ মুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র। সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির আন্দোলনে নিবেদিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, দেশ স্বাধীন এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গঠন ও পরিচালনায় যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের ৫০ বছর ধরে তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ, বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি আদায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভূমিকা ছিল।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর আশির দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন সূচিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সঠিকপথে রাখতে ছোটখাটো আন্দোলন আর একাডেমিক সমালোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গও বিচ্ছুরিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষায় অবদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েও সমান আলোচনা হয়ে থাকে।
ইতিহাসের পাতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করেছিল ব্রিটিশরাজ। হিন্দু জমিদারসহ প্রভাবশালীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পরে সেই বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হয়েছিল। তবে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিহাসে আরও দেখা যায়, প্রভাবশালীরা তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল।
কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন মুসলিম নেতারা ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে এ নিয়ে দেনদরবার করেন। এ লক্ষ্যে তখনকার ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে বিশিষ্ট নেতারা ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন। এর তিন দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি ভাইস রয়ের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা আকারে প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওই বছরই ২৭ মে নাথান কমিশন গঠন করা হয়।
এ অবস্থায় প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম থমকে যায়। যুদ্ধ শেষে ফের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন এ অঞ্চলের মুসলিম নেতারা। এ অবস্থায় ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ‘স্যাডলার কমিশন’ গঠন করে। দুই বছর পর ১৯১৯ সালের মার্চে স্যাডলার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পায়। এরপর ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ দি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট নামে ভারতীয় আইনসভায় পাশ হয়। সেই আইন অনুযায়ী ১৯২১ সালের ১ জুলাই ছাত্রছাত্রীদের জন্য দ্বারোন্মোচন হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ঢাকায় ওই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা ছিল রমনা। ওই এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ ছিল। একটি পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। আবাসিক হলগুলো হচ্ছে- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল-যা এখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হল। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন।
আর শতবর্ষ পরে আজকে এই বিশ্ববিদ্যালয় মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অনুষদ ১৩টি, বিভাগ ৮৪টি, ইনস্টিটিউট ১৩টি, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র ৬১টি। আবাসিক হল ১৯ এবং হোস্টেল ৪টি। আর শিক্ষার্থী ৪৬ হাজার ১৫০ জন ও শিক্ষক ২০০৮ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪ হাজার ৪৫৫ জন। এমফিল গবেষক ১১৬১ ও ও পিএইচডি গবেষক আছেন ১০৪৩ জন। এখন পর্যন্ত এমফিল ডিগ্রি পেয়েছেন ১৭০৮ ও ও পিএইচডি ১৫৮৮ জন পেয়েছেন।
সম্প্রতি ডিবিএ (ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ডিগ্রিও প্রদান করা হচ্ছে। ৬০০ একরে ক্যাম্পাস যাত্রা করলেও বর্তমানে এর পরিধি ২৭৫ দশমিক ৮৩ একর। সম্প্রতি সরকার পূর্বাচলে ৫১.৯৯ একর জমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দিয়েছে। কৃতী শিক্ষার্থীদের মেডেল, বৃত্তি ও সম্মাননা দিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে ট্রাস্ট ফান্ড আছে ৩৪৭টি।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। কখনো আর্থিকভাবে আবার কখনো সামরিক-সরকারি অভিযানের মুখে পড়েছে। সবমিলে দমনে মরিয়া ছিল সরকারগুলো। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে। বর্তমানেও অপ্রতুল বাজেটের বিপরীতে সক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানান সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাশাপাশি একাডেমিক দিক থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকট নিয়েই দিন কাটাচ্ছে। মান্ধাতা আমলের শ্রেণিকক্ষে চলছে ক্লাস। গবেষণাগারেরও তথৈবচ অবস্থা। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের সেবাও আধুনিক নয়। উপরন্তু আবাসিক হলে ও ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা শারীরিক-মানসিক সংকটে পড়ছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে চলছে ভাটা। শিক্ষকদের একটি অংশের নিয়মিত ক্লাস না নেওয়া এবং একাডেমিক কার্যক্রমের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও ভিন্নদিকে মনোনিবেশ বেশি থাকার অভিযোগও আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান দুটি চাপ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, শিক্ষার্থী ভর্তি ও বাজেটের অপ্রতুলতা। আমাদের বাজেটের অপ্রতুলতার কারণ হচ্ছে, আমাদের জাতীয় বাজেটই শিক্ষাবান্ধব নয়। তিনি বলেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ সুবিধা আছে, তার সদ্ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।