ঢাকায় বেড়েছে ছিনতাই, বেশি মোহাম্মদপুরে

বর্ধিত নজরদারি এবং বিশেষ অভিযানের মধ্যেও রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বেড়েছে ছিনতাইকারী আতঙ্ক। সাম্প্রতিক অপরাধের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে।

পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে বা যখন কেউ হাতেনাতে ধরা পড়ে তখন তারা দ্রুত বিচার আইনে ওই ঘটনা রেকর্ড করে। তবে পাঁচ জনের কম লোক ছিনতাই বা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকলে তখন পেনাল কোডের অধীনে মামলা হয়। এসব মামলাকে পুলিশ ‘ডাকাতি’ (দস্যুতা) মামলা বলে থাকে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম ডেটাবেসে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সারা দেশে মোট ১৫৯টি ‘ডাকাতি’ মামলা করা হয়েছিল, যা নভেম্বরে ছিল ১৩৩টি।

২০২৪ সালে এই মামলার সংখ্যা আগের বছরের ১ হাজার ২২৭টি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪১২টিতে দাঁড়িয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে কারণ অনেকেই এসব ঘটনায় মামলা করেন না, আবার অনেকে আইনি ঝামেলা এড়াতে ছিনতাইয়ের ঘটনাকে জিনিসপত্র হারানো গিয়েছে উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি করেন।

সোমবার (১৩ জানুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং খুনের মতো অপরাধ বন্ধে পুলিশকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম

একই সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার এসএম সাজ্জাত আলী বলেন, ছিনতাইকারী এবং চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে জোর দেওয়ার পর একটি সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে এই স্থানগুলোতে কমপক্ষে ৯৭৯ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে এবং তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার আসামি।

প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অভিযান চলাকালীন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ৯১ জন, নভেম্বরে ১৪৮ জন এবং ডিসেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৫৬৪ জন।

কখনো প্রাণঘাতী: গ্রেপ্তার ও নজরদারি বাড়ানোর জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরির মতো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পরও, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মানুষ মূল্যবান জিনিসপত্র, টাকা পয়সা এবং কখনও কখনও তাদের জীবন পর্যন্ত হারাচ্ছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর ইসলামপুরের একটি পোশাকের দোকানের কর্মচারী ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে মগবাজারে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

ভোর পৌনে ৬টার দিকে তার বাড়ি ময়মনসিংহে থেকে ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে।

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাজু বলেন, তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছেন, তবে এখনও কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি।

পুলিশ সূত্র যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ এবং মীরহাজিরবাগকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ছিনতাই এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে মাদকাসক্ত ছিনতাইকারীরা প্রায়শই মোবাইল ফোনের জন্য মানুষজনকে টার্গেট করে।

যেমন গত ১৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সায়েদাবাদে কাপড় ব্যবসায়ী কামরুল হাসানকে (২৩) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ফারুক আহমেদ জানান, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফারুক বলেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা মোবাইল ফোন দিতে অস্বীকার করায় কামরুলকে ছুরিকাঘাত করে বলে জানিয়েছে।

‘ছিনতাইয়ের হটস্পটগুলোতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র ডিসেম্বর মাসেই আমরা ৪৫ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছি এবং জানুয়ারির প্রথম দশ দিনে আমরা আরও ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছি, যার মধ্যে শীর্ষ তালিকাভুক্ত ১০ জন ছিনতাইকারীও রয়েছে,’ বলেন তিনি।

হাজারো ছিনতাইকারী: গত ২ জানুয়ারি সকাল ৬টার দিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কাজল আহমেদ (৪৪) এবং তার তিনজন আত্মীয় রায়সাহেব বাজারে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একটি অটোরিকশায় করে খিলগাঁওয়ের বাসায় ফিরছিলেন।

খিলগাঁওয়ের আদর্শ লেনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলে থাকা তিন ব্যক্তি অটোরিকশা থামিয়ে তাদের মোবাইল ফোন এবং টাকা দিতে বলেন। কাজল জিনিসপত্র দিতে দেরি করলে, ছিনতাইকারীরা তার বাম উরুতে ছুরিকাঘাত করে এবং দুটি মোবাইল ফোন এবং নগদ ৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

কাজলের ভাগ্নী নাজমুন নাহার তন্বী বলেন, ঘটনার পর আমরা খিলগাঁও থানায় মামলা করেছি, কিন্তু পুলিশ এখনো ফোন কিংবা টাকা উদ্ধার করতে পারেনি, অথবা কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি।’

ছিনতাই সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের অধীনে খিলগাঁও, যেখানে ওয়ারি ডিভিশনও রয়েছে সেখানে কমপক্ষে ২১২ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে।

মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে প্রায় ৩৮৬ জন, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২১৭ জন এবং উত্তরা ও গুলশানে ১৫৪ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর এবং বিমানবন্দর এলাকায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িতদের মধ্যে টঙ্গী ও আশুলিয়ার লোকজনও রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, টঙ্গী সেতু থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ব্যস্ততম সড়কে প্রতি রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। কখনো কখনো প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাইকারীরা ব্যক্তিগত গাড়ি এবং বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন বা স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এসএন মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, ছিনতাইয়ের স্পট ও ছিনতাইকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা রোধে আমরা এই স্থানগুলিতে ইউনিফর্ম এবং সাদা পোশাকে অফিসার মোতায়েন করেছি। এর পাশাপাশি, তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য আমরা অভিযান চালাচ্ছি।

হটস্পট মোহাম্মদপুর: তালিকায় উঠে এসেছে মোহাম্মদপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

তালিকা অনুসারে, মোহাম্মদপুর থানার আওতাধীন এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি ১০৮টি ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইবনে মিজান বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকাটি নদী এবং বেড়িবাঁধের (বাঁধ) কাছাকাছি হওয়ায় বিপুল সংখ্যক গৃহহীন মানুষ এখানে বাস করে এবং কাজ করে। এছাড়া অপরাধ করার পর বেড়িবাঁধ ব্যবহার করে যে কেউ সহজেই গাবতলী, পুরান ঢাকা এবং কেরানীগঞ্জে পালিয়ে যেতে পারে। গত বছরের অপরাধের তথ্যের ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তাই পুলিশ এখন তালিকা অনুসরণ করে নজরদারি এবং টহল বাড়াতে পারবে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারবে।

Comments (0)
Add Comment