ঢাকায় দিনে পরিবহনে চাঁদাবাজি সোয়া ২ কোটি টাকা!

রাজধানী ঢাকায় ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হয়। প্রতি মাসে এটি ৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আবার কখনো তা বেড়ে ৮০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছায় বলে একটি সরকারি তদন্তে উঠে এসেছে।  গত ১১ ফেব্রুয়ারি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে আরও দেখা গেছে যে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজির একটি ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। তারা একটা টোকেন ব্যবহার করতেন। তবে এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কারণ চাঁদাবাজির চিহ্ন রয়ে যেত কাগজে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ব্যবস্থার দখল নেয় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

বর্তমানে রাজধানী এবং এর আশেপাশের এলাকায় বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, হিউম্যান হলার (লেগুনা) এবং অটোরিকশাসহ ৯৫ ধরনের টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ডই রয়েছে রাজধানীতে।

এর মধ্যে রয়েছে ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড, সাতটি স্থানীয় বাস স্ট্যান্ড, পাঁচটি পিকআপ স্ট্যান্ড, চারটি স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা বাস স্ট্যান্ড, চারটি অটোরিকশা স্ট্যান্ড, তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, দুটি ট্রাক স্ট্যান্ড এবং একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড।

৫৬টি টার্মিনালে তদন্ত চালানো হলে ৫৩টিতেই চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়, বিএনপি-সমর্থিত নেতারা বিভিন্ন মালিক সমিতির পাশাপাশি টার্মিনালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নেন।

এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, যিনি টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ছিলেন, তাকে সরিয়ে তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন কুমিল্লা (উত্তর) বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম।

গত বিএনপি আমলে সাইফুল ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দুইবারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

অন্যদিকে, স্টার লাইন গ্রুপের মালিক এবং এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাজী আলাউদ্দিন পরিবহন মালিক সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গার স্থলাভিষিক্ত হন।

হাজী আলাউদ্দিন জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তারপর থেকে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে পরিবহন বিভাগের সূত্রে জানা গেছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে রাঙ্গা এবং এনায়েত উল্লাহ দুজনেই পলাতক।

পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বেও একই রকম পরিবর্তন দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান, যাকে একসময় সংগঠনের ‘অবিসংবাদিত’ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আব্দুর রহিম বক্স দুদু। সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন হুমায়ুন কবির খান।

ট্রাক বহর পরিচালনা থেকে উঠে আসা আব্দুর রহিম বক্স স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত বলে সূত্র জানিয়েছে।

অন্যদিকে, হুমায়ুন কবির খানের ফেসবুক প্রোফাইল অনুসারে, বিএনপিতে তার পদ রয়েছে, তিনি দলে শ্রম বিষয়ক সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অতীতে আওয়ামী লীগের লোকজন চাঁদাবাজির জন্য টোকেন, রশিদ এবং স্টিকার ব্যবহার করত। কিন্তু নতুন চাঁদাবাজরা ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতে অভিনব পদ্ধতি চালু করেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও লাইনম্যানদের বেতন পরিশোধের অজুহাতে এখন চাঁদাবাজি হচ্ছে এবং নগদ অর্থ এবং বিকাশ ব্যবহার করে লেনদেন হচ্ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নতুন মহাসচিব সাইফুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, পরিবহন খাত চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত। ৫ আগস্টের পর মালিক ও শ্রমিক সমিতির সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনগুলো টোল আদায় করছে।’

চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি এই নেতা। বলেন, ‘আমি আপনাকে এটুকু বলতে পারি যে দূরপাল্লা, আন্তঃজেলা এবং আন্তঃনগর বাসে কোনো চাঁদাবাজি হয় না। তবে যদি অটোরিকশা, সিএনজি বা পণ্যবাহী ট্রাকে কোনো চাঁদাবাজি হয়, তবে আমি বলতে পারছি না। এই খাতগুলি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।’

তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, দৈনিক ২ কোটি ২১ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মধ্যে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা পরিবহন মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজি হয়।

সিটি করপোরেশন, টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের ফি, কাউন্টার ও টার্মিনালের খরচ, শ্রমিক, লাইনম্যান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীদের ফি আদায়ের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। সংস্থার পক্ষ থেকে এমন ১১ ধরনের পেমেন্টের প্রমাণ পেয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে যে, দূরপাল্লার ও মাঝারি পাল্লার বাস, ট্রাক, পিকআপ এবং কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এমনকি রিকশা থেকেও চাঁদাবাজি করছে দুর্বৃত্তরা।

হটস্পট ও সুবিধাভোগী: রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা- গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং মহাখালীতে তিনটি প্রধান আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল অবস্থিত। গাবতলীতে ২৪০টি, সায়েদাবাদে ১০৮টি এবং মহাখালীতে ৮৮টি টিকিট কাউন্টার রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই তিনটি টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ১ কোটি সাত লাখ টাকা, স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা বাস স্ট্যান্ড থেকে ৮০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

গত বছরের মার্চ মাসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সারা দেশে প্রতি বছর বাসগুলোকে কমপক্ষে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা অবৈধ টোল এবং ঘুষ হিসেবে দিতে হয়।

টিআইবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ কর্মকর্তা, পরিবহন সমিতি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মী এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ঘুষ এবং চাঁদাবাজির অর্থের ভাগ পেয়ে থাকেন।

তবে আশ্চর্যজনকভাবে এজেন্সির তদন্তে দেখা গেছে যে এবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ বাদ পড়েছে। বর্তমানে চাঁদাবাজির টাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুটি অংশ এবং লাইনম্যানদের মধ্যে ভাগ হচ্ছে।

তবে তিনটি টার্মিনালে কিছু ট্রাফিক পুলিশ লাইনম্যানদের মাধ্যমে তাদের ‘ন্যায্য হিস্যা’ পেতে সক্ষম হচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এই প্রথা বন্ধ করার জন্য, প্রতিবেদনে বাস টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ডগুলোকে বেসরকারিকরণ এবং এগুলো ব্যবহারকারী যানবাহন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ডগুলো কমিশনের অর্থ ব্যবহার করে পরিচালিত হবে।

এছাড়া সড়ক আরও ভালোভাবে পরিচালনার জন্য বাস ফ্র্যাঞ্চাইজিং চালু করা এবং একটি টেকসই পরিবহন ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরির সুপারিশও করা হয়।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গত কয়েক মাসে ‘ভাড়া আদায়’ এবং সম্পত্তি ও ব্যবসার অবৈধ দখলে জড়িত থাকার অভিযোগে দলের ১ হাজারের বেশি সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর ১২টিরও বেশি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, যারা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারা কখনই বিএনপির ১৬ বছরের আন্দোলনের অংশ ছিল না। দলের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত কাউকে বিএনপির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।

সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান বলেন, সরকার পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আমরা যখনই অভিযোগ পাচ্ছি তখনই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিআরটিএও ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। এই খাতের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকে, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব।’

Comments (0)
Add Comment