টোল আদায় ছাড়াও পদ্মা সেতুর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উপায়

মোঃ সাইফুল আলম তালুকদার
গত সপ্তাহে পদ্মা সেতু পেরিয়ে একেবারে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জের শেষ পর্যন্ত ঘুরে এলাম। চোখে পড়ল বিশাল বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি। অথচ পদ্মা সেতুর প্রধান প্রত্যক্ষ আয়ের উৎস এখন পর্যন্ত কেবল টোল আদায়, যা যানবাহন চলাচলের উপর নির্ভরশীল। পদ্মা সেতুর টোল আয় প্রতিদিন বাড়লেও, এর নির্মাণ ব্যয়ের বিপরীতে তা খুবই সামান্য। এমন একটি বিশাল প্রকল্পের ব্যয় মেটানো বা দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়ার জন্য শুধুমাত্র টোল আদায় কখনোই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এর আশেপাশে নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলা।

 

 

সেতুর আগে-পরে এবং সংযোগ সড়কের আশেপাশে যে জমিগুলো খালি পড়ে আছে, সেগুলো ব্যবহার করে অনেক কিছু করা যেত। শিল্প কারখানা, কৃষি-প্রসেসিং অঞ্চল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, রিসোর্ট, চিড়িয়াখানা কিংবা ছোট নতুন শহর গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। লজিস্টিক হাব, ওয়্যারহাউস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এখানে গড়ে উঠতে পারত। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে পদ্মা সেতু শুধুই একটি সংযোগ সেতু থাকত না, বরং হয়ে উঠত একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক করিডর। ঢাকার আশেপাশে নতুন শহর গড়ে উঠলে মানুষজন যানজট বা দূষণ থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেত।

 

 

আরেকটি সম্ভাবনা হলো বিদ্যুৎ সাশ্রয়। সেতুর পাশে, সংযোগ সড়কের দু’পাশে কিংবা লাইট পোস্টগুলোর উপর সোলার প্যানেল বসানো যেত। এতে করে বিদ্যুতের খরচ কমত, আবার পদ্মা সেতুকে একটি ‘সবুজ জ্বালানি প্রকল্প’ হিসেবেও বিশ্বে তুলে ধরা যেত। সেতুর পাশে ও সংযোগ সড়কের দু’পাশে বিশাল জমিতে অন্ততপক্ষে সোলার প্যানেল ফার্ম বসানো যেত।

 

 

এসব প্রকল্প কেবল সরকারি আয়ের উৎস বাড়াত না, বরং স্থানীয় কর্মসংস্থান, পর্যটন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও আকৃষ্ট করত।

 

 

ভারত ও চীনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষা হতে পারে। তারা বড় কোনো সেতু বা মহাসড়ক বানালে কেবল সেই অবকাঠামোতেই থেমে থাকে না; বরং তার আশেপাশে অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্পনগরী, পর্যটন কেন্দ্র ও বিদ্যুৎ উৎপাদন সুবিধা গড়ে তোলে। ফলে অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিজে থেকেই রাজস্ব আয় বাড়ায় এবং বিনিয়োগের অর্থ দ্রুত ফেরত আসে।

 

 

চীনের ইয়াংজি নদীর সেতুগুলোর চারপাশে গড়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল ও নতুন শহর, যা সেতুর টোল আয়ের পাশাপাশি বিপুল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরি করেছে। ভারতের কলকাতা ও মুম্বাইয়ের আশেপাশে হাইওয়ে করিডরগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শিল্পনগরী ও আইটি হাব। তারা শুধু অবকাঠামো নয়, বরং অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে সমন্বিত উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

 

 

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য একটি স্বপ্নপূরণের নাম। কিন্তু এর আশেপাশের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে এটি কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবিক অর্থে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

 

 

তাই বলা যায়, পদ্মা সেতু শুধু একটি সংযোগ সেতুই নয়, বরং এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি অর্থনৈতিক করিডর বা গ্রোথ করিডোর। কিন্তু বাস্তবে এখনো তা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। অতিরিক্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছাড়া এর পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন কঠিন।

 

 

কিন্তু কেন এগুলো হয়নি? সরকারি পরিকল্পনার অভাব এবং বন্ড মার্কেটের দুর্বলতা এর প্রধান কারণ।

 

 

পদ্মা সেতু যদি কেবল কেবল টোলের উপর নির্ভরশীল থাকে, তবে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসতে ৩৫-৪০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কিন্তু সেতুর আগে-পরে নতুন শহর, শিল্পনগরী, রিসোর্ট, লজিস্টিক হাব কিংবা কৃষি-প্রসেসিং অঞ্চল গড়ে তোলা হলে এই সময় কমে ১৫-২০ বছরের মধ্যেই আসতে পারে। অর্থাৎ, সেতুর আশেপাশে বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বিনিয়োগ ফেরত দ্বিগুণ গতিতে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

 

 

এক্ষেত্রে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যম হতে পারত দেশের বন্ড মার্কেট, যদিও সেটা একেবারে ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। সরকার ‘অবকাঠামো বন্ড’, ‘গ্রীন সুকুক বন্ড’ বা বিশেষ ‘পদ্মা ব্রিজ ইকোনমিক করিডোর বন্ড’ ইস্যু করতে পারত। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, প্রবাসী বাংলাদেশি কিংবা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পেত। এতে একদিকে অর্থায়নের নতুন পথ খুলত, অন্যদিকে জনগণের কাছে প্রকল্পটি আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠত।

 

 

ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড শিল্পাঞ্চল, রিসোর্ট, পর্যটন কেন্দ্র ও লজিস্টিক হাব নির্মাণের জন্য কাজে লাগানো যেত। ইসলামিক ফাইন্যান্স ভিত্তিক গ্রীন সুকক বন্ড দিয়ে সেতুর চারপাশে সোলার এনার্জি প্রজেক্ট বা নতুন সবুজ শহর গড়ে তোলা যেতে পারে। এছাড়া ডায়াসপোরা বন্ডের মাধ্যমেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ দেশের আইকনিক প্রকল্পে অংশ নিতে পারত এবং রেমিটেন্সের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেত। ‌

 

 

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শহর, শিল্প এলাকা কিংবা পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলার মধ্যে যেমন বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু ঝুঁকিও। সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গা হলো নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ। পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম অস্থির নদী, যার প্রবল স্রোত ও ভাঙন প্রবণতা রয়েছে। সেতুর কাছাকাছি ভারী অবকাঠামো গড়ে তুলতে গেলে নদীর গতিপথে পরিবর্তন আসতে পারে, আর সেই পরিবর্তন যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে সেতুর পিলার ও আশেপাশের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

 

 

অন্যদিকে, নতুন শিল্প এলাকা বা লজিস্টিক হাব গড়ে উঠলে সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহনের চাপ বহুগুণ বাড়বে। এতে টোল আয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। একইসঙ্গে আশেপাশে নগরায়ণ হলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথ ব্যাহত হতে পারে। এতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে সেতুর সংযোগ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

 

 

এ কারণে পদ্মা সেতু কেন্দ্রিক যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আগে অবশ্যই হাইড্রোলজিক্যাল স্টাডি করতে হবে, যেখানে নদীর স্রোত, পানির উচ্চতা ও ভাঙন প্রবণতা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ থাকবে। পাশাপাশি সেতুর চারপাশে একটি নিরাপদ দূরত্ব জুড়ে সবুজ বাফার জোন রাখা জরুরি, যাতে সেতুর মূল কাঠামো সরাসরি নগরায়ণ বা শিল্পায়নের প্রভাবের মধ্যে না পড়ে। পরিকল্পিতভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নিয়মিত ড্রেজিং থাকলে নদীর স্রোত নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে।

 

 

অতএব, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শহর বা অবকাঠামো গড়ে তোলার সম্ভাবনা যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনতে পারে, তেমনি যদি পরিকল্পনা ছাড়া এগোনো হয় তবে তা সেতুর জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এই উন্নয়ন অবশ্যই স্মার্ট আরবান প্ল্যানিং ও নদী ব্যবস্থাপনার সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।