টিউলিপ’স টেরিটরি: শেখ রেহানার বাগানবাড়ি, আছে শানবাঁধানো ঘাট, পুকুর

গ্রামীণ পরিবেশ, ভেতরে বিশাল বাগানবাড়ি। রয়েছে ডুপ্লেক্স বা দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাট ও পুকুর। বাগানবাড়িটির নাম টিউলিপ’স টেরিটরি। অবস্থান গাজীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকায়। টিউলিপ’স টেরিটরি নামকরণ হয়েছে সম্প্রতি পদত্যাগ করা ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে। নথিপত্রে বাড়িটির মালিক শফিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার স্বামী ও টিউলিপের বাবা।

টিউলিপ’স টেরিটরিসহ গাজীপুরে চারটি বাগানবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর মালিক শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। বাগানবাড়িগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য, স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বাগানবাড়িগুলোতে বেড়াতে যেতেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তাদের যাতায়াত বেশি ছিল। মাঝেমধ্যে রাতে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়ি প্রবেশ করত। তখন বাংলোর চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকত। কখনো কখনো ভোরেই গাড়িগুলো চলে যেত। কখনো কখনো দু-এক দিন থাকত।

চারটি বাগানবাড়ির মধ্যে একটির মালিক শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। একটির মালিক শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক। বাকি দুটির মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

স্থানীয়ভাবে বাড়িগুলো শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যদের বলে প্রচলিত ছিল। স্থানীয় ভূমি কার্যালয় থেকে যতটুকু নথিপত্র পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, চারটি বাগানবাড়ির দলিলাধীন জমির পরিমাণ ৮১৬ শতক বা ২৫ বিঘা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, জমির পরিমাণ এর অনেক বেশি। গড় মৌজা মূল্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ২৫ বিঘা জমির দাম প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বর্তমান বাজার মূল্যে এই জমির দাম ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।

টিউলিপ’স টেরিটরিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ও কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা। এই দুই বোনের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কী কী সম্পদ আছে, তা খোঁজ করছে। সংস্থাটি তথ্য চেয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসনকে চিঠিও দিয়েছে।

জানতে চাইলে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব ও এলএ) মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন, ‘দুদক থেকে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জমির তথ্য চেয়েছে। আমরা এরই মধ্যে জেলার সবগুলো ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে জমির তথ্য চেয়েছি। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে তাঁদের নামে কী পরিমাণ জমি রয়েছে।’

গাজীপুরের কানাইয়া সিটি করপোরেশনের মধ্যে হলেও সেখানকার পরিবেশ গ্রামীণ এলাকার মতোই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িঘর মাটির। কেউ কেউ আধা পাকা ও পাকা ভবন করেছেন। গাজীপুরের যেসব এলাকায় রিসোর্ট বেশি, তার মধ্যে একটি কানাইয়া।

টিউলিপ’স টেরিটরিতে ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কানাইয়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ও কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে। সব জায়গায় ভাঙচুরের চিহ্ন, ডুপ্লেক্স বাড়ির একাংশ পোড়া। বাড়ি পাহারায় কোনো লোকজন নেই। বিশাল একটি পুকুরেরর ভেতরে দুটি নৌকা।

বাগানবাড়িটির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর একদল লোক বাগানবাড়িটিতে ভাঙচুর করেছে। তখন থেকে আর বাড়ির মালিকপক্ষ বা নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। আগে অনেক নিরাপত্তা ছিল। বাড়িটি কার, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে এটা শেখ রেহানার বাড়ি।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিবছর শীতের সময়ে দেখতাম বাড়িটি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা। পতাকা লাগানো গাড়িও আমরা আসতে দেখেছি।’

গাজীপুর পৌর ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে টিউলিপ’স টেরিটরির ২৬৩ শতক (প্রায় আট বিঘা) জমির নামজারির নথি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, জমির মালিকানা শফিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। টিউলিপ’স টেরিটরির সীমার ভেতরে এখনো নামজারি না হওয়া শফিক আহমেদ সিদ্দিকের মালিকানাধীন জমি আছে কি না, তা জানা সম্ভব হয়নি।

টিউলিপ’স টেরিটরির সীমানা ইটের দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সীমানা চিহ্নিত এলাকায় জমির পরিমাণ আট বিঘার কয়েক গুণ হবে। বিষয়টি নিয়ে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, হতে পারে জমি কেনা হয়েছে, এখনো নামজারি হয়নি।

গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে রয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের একটি বাগানবাড়ি। এলাকাটি শিল্পঘন।

স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ জমি লিখে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জমির কিছু অংশ সন্তানদের লিখে দেন। সেই সূত্রে মালিক হন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, রাদওয়ান সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। নথিপত্রে জমির পরিমাণ ২৯৭ শতক (৯ বিঘা)। তবে এ ক্ষেত্রেও স্থানীয়দের ভাষ্য, বাস্তবে জমির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।

‘ডামি ভোট’ নামে পরিচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া শেখ হাসিনার হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি নিজের নামে সাড়ে ১৫ বিঘা কৃষিজমি দেখিয়েছেন, যা টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও রংপুরে অবস্থিত।

তেলিরচালা গিয়ে দেখা যায়, বাগানবাড়িটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একটি দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর, সুইমিংপুল (সাঁতার কাটার জন্য নির্মিত পাকা জলাধার) ও খোলা জায়গা রয়েছে। বাড়িটির ফটকে কোনো নাম নেই। ফটকটি ভাঙা। ভেতরে কয়েকটি শিশু খেলছিল। কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁরা জানান, ৫ আগস্ট এই বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তারপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। মাঝে এক দফায় কোনো এক রাতে ইটের দেয়াল তুলে ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা কে বা কারা ভেঙে ফেলেছে।

বাড়িটির কাছে পাওয়া যায় স্থানীয় বাসিন্দা আলমাছ হোসেনকে। তিনি বলেন, বছরে কয়েকবার বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হতো। তখন লোকজন বলাবলি করত, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তখন ধারেকাছেও যেতে পারতাম না। তারা না থাকলেও বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা থাকত।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, বাগানবাড়িটি দেখাশোনা করতেন কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে।

Comments (0)
Add Comment