জলবায়ু পরিবর্তন: তীব্র তাপদাহের ইঙ্গিত এবারও!

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং কার্বন নিঃসরণ

‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’— একসময় এই প্রবাদটি গ্রামবাংলার প্রচলিত একটি উপমা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সম্পূর্ণ ওলট-পালট হয়ে গেছে আবহাওয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি, জনজীবন, অর্থনীতি সহ সামগ্রিক বিষয়গুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে, শীতকাল বা মাঘ মাস জুড়ে হাঁড়কাপানো শীতের অনুভূতি দূরে থাক, বরং মাঘ মাস শেষ হওয়ার আগেই শীত শেষ হয়ে গেছে। গ্রীষ্মকাল শুরুর আগেই ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রচণ্ড গরমের।

এমন অবস্থায়, গত ২ বছরের মতো এবারও দীর্ঘ সময়জুড়ে গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকাল চলমান থাকেতে পারে। ফলে, বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি এবং তাপপ্রবাহের কারণে মানুষজন নাকাল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গ্রীষ্মের মতোই গরম শুরু হতে পারে বলেও মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।


২০২৪ সালে ঢাকায় প্রচণ্ড গরমে মাথায় পানি ঢালেন এমন রিকশাওয়ালা, শ্রমিক। ছবি: সংগৃহীত

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ১২ মাসের স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা প্রায় প্রতিটি মাসেই খুব কাছাকাছি ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ২৫.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মার্চ মাসে ৩১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এপ্রিল মাসে ৩৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মে মাসে ৩২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জুন মাসে ৩১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জুলাই মাসে ৩১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আগস্ট মাসে ৩১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেপ্টেম্বর মাসে ৩১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অক্টোবর মাসে ৩১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, নভেম্বর মাসে ২৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ডিসেম্বর মাসে ২৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বছরের ৪টি মাস ছাড়া বাকি সবগুলো মাসেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা সিথ্রিএস-এর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি, যা বন্যা, খরা এবং তীব্র দাবদাহের মতো চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, ২০২৪ সালের ১০ জুলাই বিশ্বব্যাপী ৪৪ শতাংশ অঞ্চল চরম তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ২২ জুলাই ছিল রেকর্ড করা ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ দিন। বাংলাদেশে গত বছরের এপ্রিল মাসে ২৬ দিনের তাপপ্রবাহের রেকর্ড ছিল। ওই সময় গরমে হিটস্ট্রোক করে প্রায় ১৫ জন মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সে অনুযায়ী এবছরও অত্যধিক তাপমাত্রা এবং তাপপ্রবাহ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, বছরের শুরুতেই যার কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দিনের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি অনুভূত হয়েছে (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দুটোই বেশি ছিল)। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের বেলায় বেশ গরমের অনুভূতি হয়েছে।

এমন অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান অবস্থা এবং বৈশ্বিক পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সালে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি গরম পড়তে পারে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, গতবারের মতো এবছরও তাপমাত্রা খানিকটা বেশি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাপমাত্রা ঠিক কোন সময় বেড়ে যাবে, এটি সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যাচ্ছে, এই বছরের গ্রীষ্মকাল বেশ পাকাপোক্তই হবে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ। ছবি: সংগৃহীত

বজলুর রশিদ আরও বলেন, পরিবেশের উষ্ণতা সারা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। সেজন্য গত বছরের মতোই এবার অস্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে তাপপ্রবাহের ধরনও বদলেছে। সাধারণত আগে তাপপ্রবাহ মার্চ মাসে শুরু হতো, কিন্তু গত বছর এপ্রিল মাসে শুরু হয়েছে। যেমন দেরিতে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে, তেমন দীর্ঘ সময় এটি অবস্থান করেছে। আর এই মাসে (ফেব্রুয়ারি) প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই ভোর-সকালবেলা কিছুটা শীতের অনুভূতি থাকলেও ৯টার পর থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তখন আবার দিন বড় হয়ে যাবে। ফলে গরমের অনুভূতিও বেশি থাকবে বলে মন্তব্য করেন এই আবহাওয়াবিদ।

জলবায়ুর পরিবর্তন কৃষি উৎপাদন, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা—সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একসময় যে ছয়টি ঋতু একে অপরের পরিপূরক ছিল, সেটি এখন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এর প্রভাবে কখনো বেশি বৃষ্টি, কখনো অতিরিক্ত গরম, আবার কখনো দীর্ঘ খরার প্রকোপ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় এবছরও বেশি তাপমাত্রা ভোগান্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক।

আবুল কালাম বলেন, ২০২২ সাল থেকে ২০২৭ পর্যন্ত বছরগুলো উষ্ণতম বছর হিসেবে ধরা হয়েছে। বৈশ্বিক আবহাওয়া অফিসগুলো এমন পূর্বাভাসই দিয়েছে। এর কিছু বাস্তবিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। যেমন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির নিচে রাখার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটি গত বছরই ভঙ্গ হয়েছে। কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিঃসৃত গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে। দিন দিন এটি পৃথিবীকে আরও উষ্ণ করছে। এছাড়া আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। গ্রামে এখন আর আগের মতো জলাশয়ও নেই। খাল-বিল সমানতালে ভরাট করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা কমানোর উপাদানগুলো কমে যাচ্ছে।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক। ছবি: সংগৃহীত

আবুল কালাম আরও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং কার্বন নিঃসরণ সামগ্রিকভাবে একটি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে যদি আমরা এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিই।

Comments (0)
Add Comment