চা মৌসুমের শুরুতেই অনাবৃষ্টির কারণে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন বাগানের চা গাছ বিবর্ণ হয়ে পাতা পুড়ে যাচ্ছে। নদ-নদী, ছড়া, জলাশয় ও লেক শুকিয়ে যাওয়ায় চাহিদামতো সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুন কুঁড়ি আসছে না গাছে, ফলে চা উৎপাদনে ভাটা পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাবৃষ্টির কারণে চা শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। পাতা উত্তোলন মৌসুমের শুরুতেই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তাই চা উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা বাগান রয়েছে। তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে চা গাছ মরে যাচ্ছে। প্রুনিং (ছাঁটাই) করা ডালে নতুন কুঁড়ি গজাচ্ছে না। দেখা দিচ্ছে নানা রোগ-বালাই। এ নিয়ে হতাশ চা সংশ্লিষ্টরা।
জেলা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৪ মিলিমিটার। ২০২৪ সালে একই সময়ে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৪৬ মিলিমিটার।
সম্প্রতি কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার কয়েকটি চা বাগান ঘুরে দেখা যায়, অনেক চায়ের টিলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাপদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে বাড়ছে না চা গাছের কুঁড়ি। খরায় মরে গেছে প্রুনিং করা গাছ।
এ সময়ে জানা যায়, চা গাছে নতুন পাতাও আসছে না। খরায় নতুন চা-গাছের ৩০ শতাংশ এবং পুরাতন চা গাছের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু টিলায় নিয়মিত সেচ দিয়ে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে। গত দুই-তিন মাসে হালকা বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চলমান দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা বাগানের নতুন চা গাছগুলো রোদে পুড়ে মারা যাচ্ছে। অনাবৃষ্টির ফলে চা বাগানের নার্সারি বাগানগুলোও কীটপতঙ্গের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। শীত মৌসুমে বাগানগুলোতে পুরাতন বৃদ্ধ চা গাছ উপড়ে ফেলে সেখানে নতুন চারা-গাছ লাগানো হয়। বাগানের প্লান্টেশন এলাকার চা গাছ ছেঁটে দেওয়ার পর নিয়মিত সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
চা বাগানের একটি সূত্র জানান, এ সময় সাধারণত চা বাগান অঞ্চলে ১৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তবে এ বছর এ সময় শুরু হয়েছে খরা। মাঘ মাসে বৃষ্টি চা বাগানের জন্য খুবই উপকারী। কিন্তু মাঘে কোনো বৃষ্টি না হওয়ায় চলমান অনাবৃষ্টিতে চা বাগান প্লান্টেশন এলাকায় পানির উৎস খুঁজে তা আটকিয়ে কিছু অংশে সেচ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যেসব প্লান্টেশন এলাকায় সেচ দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানকার নতুন চারাগাছ মরে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজার আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান জানান, এই সময়ে চা অঞ্চলে ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গত বছরের মার্চ মাসে ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল, অথচ চলতি বছরের মার্চে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বাংলাদেশ চা সংসদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলেন, চা-গাছ রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও পানির অভাবে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে চা রপ্তানি আগের তুলনায় কমে গেছে। যদি উৎপাদন ঘাটতি হয়, তবে তার প্রভাব হবে ব্যাপক।
চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, চা শিল্প বৈরী আবহাওয়া ও অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি রক্ষা করতে হলে কৃত্রিমভাবে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় খরায় বেশিরভাগ বাগানে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। গাছ মরে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, খরায় গাছ মরে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য আমরা বাগান কর্তৃপক্ষকে ছায়াতরু রোপণ, ইয়াং চা গাছে প্রুনিং এবং গাছের গোড়ায় কচুরিপানা দিয়ে খরা মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছি। এই পদ্ধতি প্রয়োগ না করলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। খরার কারণে লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা রোগ-বালাই দেখা দিতে পারে।