চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্যের অংশ ‘মেজবান’

চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতির অনন্য এক বহিঃপ্রকাশ হলো মেজবানি। এটি শুধু খাদ্যসংস্কৃতি নয়; বরং আতিথেয়তা, সামাজিক মিলনমেলা, সম্প্রীতি এবং সামষ্টিক উৎসবধর্মিতার সমন্বয়। জন্মদিন থেকে বিবাহ, রাজনীতির অনুষ্ঠান থেকে সামাজিক প্রয়োজনে মেজবান চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত এক ঐতিহ্য। মেজবানের উৎপত্তি ধারণা করা হয় চট্টগ্রামের আদি গ্রামীণ সমাজে। ‘মেজবান’ শব্দটি ফারসি ‘মিজবান’ থেকে এসেছে, যার অর্থ আতিথ্য প্রদানকারী। ব্রিটিশ আমলে সামাজিক অঙ্গনে গণভোজ হিসেবে এর প্রচলন বাড়ে।

সময়ের সঙ্গে অনুষ্ঠানটি ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরও বিস্তৃত হয় এবং বর্তমানে এটি চট্টগ্রামের এক পরিচয়বাহী সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে আতিথেয়তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মেজবানে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার জন্য খাবারের নিমন্ত্রণ উন্মুক্ত থাকে। অতিথির আগমনের সংখ্যাই যেন আয়োজকের সাফল্যের মাপকাঠি। ধনী গরিব একই টেবিলে একই চেয়ারে বসে খাবার গ্রহণ করেন। যদিও এক দশক আগে উঠানে চাটাই বা মাদুর বিছিয়ে পরিবেশ হতো খাবার।

এখন যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে চেয়ার-টেবিলে চলে এসেছে। মেজবানের পদগুলো সাধারণত গরু বা মহিষের মাংস, ঝাল মসলাযুক্ত এবং ঘন মাংসের ঝোলভিত্তিক। ঘন মাষকলাইয়ের ডাল। হাড়যুক্ত মাংস দিয়ে চনার ডাল লাউ। মেজবানি গরুর মাংস (ঝাল ও লাল-রঙের ঘন ঝোল), ডাল ও হলুদ কুমড়া, চাটগাঁইয়া সাদা ভাত, কিছু এলাকায় মেজবানিতে মুরগি বা খাসি কোরমা করা হয়। রান্নার ব্যাপারটাও অনেক ঐতিহ্যের বড় শাহি পিতলের ডেকে রান্না হয়। কড়াইতে হয় ভাত রান্না। খ্যাতিমান বাবুর্চি দিয়ে রান্নার মসলার পদগুলো দেওয়া হয় একসঙ্গে।

লাইন করে অনেকগুলো চুলাতে আগুন দেওয়া হয়। রান্নার পদ্ধতিটাও অনেক পুরোনো। এতে স্বাদ হয় আলাদা, সুনাম করতে থাকেন অতিথিরা। মেজবান আয়োজনের তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত খোলা মাঠ, বাড়ির আঙিনা কিংবা কমিউনিটি সেন্টার বেছে নেওয়া হয়। মাংস, চাল ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ শত শত কেজি মাংস ও বিপুল পরিমাণ চাল সংগ্রহ করা হয়।

রান্নার দল গঠন স্থানীয় অভিজ্ঞ বাবুর্চিদের দিয়ে ভোর থেকে রান্নার কাজ শুরু হয়। পরিবেশন লাইনে দাঁড় করিয়ে বা দলে দলে বসিয়ে সবার মাঝে খাবার পরিবেশন করা হয়। মেজবানে মানুষ একত্র হয়, আলাপ-আলোচনা করে, পুরোনো সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব গঠনে এই আয়োজনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। গ্রামের সমাজজীবনে মেজবান একতা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার অন্যতম মাধ্যম। বড় মেজবান আয়োজন স্থানীয় ব্যবসায়ী, কসাই, বাবুর্চি, সরবরাহকারীসহ বহু মানুষের আয়-রোজগারের পথ খুলে দেয়।

চট্টগ্রামে আগত বিদেশি পর্যটকরা মেজবানের স্বাদ নিতে আগ্রহী হন। ফলে এটির পর্যটন-সম্পৃক্ত গুরুত্বও বাড়ছে। বর্তমানে মেজবান শুধু গ্রামে সীমাবদ্ধ নয়; ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে ‘চাটগাঁইয়া মেজবান’ নামে রেস্টুরেন্টও গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো ‘মেজবান’কে গণসংযোগের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব প্রতিফলন হলো মেজবানি। এটি কেবল খাবার নয়- এটি সম্পর্ক, ভালোবাসা, সামাজিকতা এবং উষ্ণ আতিথেয়তার প্রতীক।

সময়ের সঙ্গে মেজবান আরও জনপ্রিয় ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে, যা চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আরও দৃঢ় করছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হোটেল এখন নিয়মিতভাবেই মেজবানি খাবারের বিশেষ আয়োজন করছে। অতিথিদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে অনেক হোটেল বুফে বা প্রি-অর্ডার প্যাকেজ চালু করেছে। পরিবার-পরিজন, করপোরেট সভা বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও এখন অতিথিরা নির্ঝঞ্ঝাটভাবে হোটেলেই মেজবান আয়োজন করেন। হোটেল ব্যবস্থাপকদের মতে, মেজবানের বিশাল রান্না, কসাই-ব্যবস্থা, মাটির চুলা বা বড় কড়াই ব্যবহারের ঝামেলা থেকে এভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে খাবারের মান, পরিবেশন ও পরিচ্ছন্নতার নিশ্চয়তাও থাকে।

হোটেলগুলো স্থানীয় বাবুর্চি বা মেজবানি রান্নায় পারদর্শী কুকদের দায়িত্ব দিয়ে ঐতিহ্যবাহী স্বাদ অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছে। ব্যস্ত নগরজীবনে বড় মাপের আয়োজনে সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, মিলাদ, করপোরেট অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভার পরিধিতে অনেকেই এখন হোটেল মেজবানকেই আদর্শ মনে করছেন।

হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, অতিথির পরিমাণ, খাবারের বৈচিত্র্য এবং বাজেট অনুযায়ী প্যাকেজ সাজানো যায়। ফলে খরচ তুলনামূলক কম এবং ব্যবস্থাপনার জটিলতা নেই। মেজবানকে ঘিরে হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো নতুন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের খাবারের প্রতি ঢাকাবাসীর আগ্রহ বাড়ার ফলে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও রেস্টুরেন্টও এখন ‘মেজবানি নাইট’, ‘চাটগাঁইয়া বুফে’ বা ‘মেজবান ফেস্ট’, ‘হোটেল জামান’ মেজবানি আয়োজন করছে। পর্যটকদের কাছেও এটি ইতোমধ্যে একটি আকর্ষণীয় খাদ্য-অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।