গোয়েন্দা জাহাজে আগুন কি রুশ নৌবাহিনীর ‘দুর্বলতা’!

ভূমধ্যসাগরে নিজেদের ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে রাশিয়ার নৌবাহিনী। এরই মধ্যে সিরিয়া উপকূলে তাদের একটি গোয়েন্দা জাহাজে আগুন লেগেছে। বিশ্লেষকদের অনেকে এবং পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, এই অগ্নিকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রুশ নৌবাহিনীর দুর্বলতাটা সামনে এসেছে।

আগুন লাগা ওই জাহাজের নাম ‘কিলডিন’। সেটি ৫৫ বছরের পুরোনো। বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) আগুন লাগার পর জাহাজটির চিমনি দিয়ে আগুনের শিখা ও ঘন কালো ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এ সময় জাহাজের মাস্তুলে দুটি কালো রঙের বল ঝোলানো ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ থেকে বোঝা যায়, জাহাজটি নাবিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

আগুন লাগার সময় কিলডিনের কাছাকাছি অবস্থান করছিল পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগোর পতাকাবাহী জাহাজ ‘মিলা মুন’। কিলডিন থেকে মিলা মুনকে সতর্কবার্তা দিয়ে বলা হয়েছিল, তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মিলা মুনকে কিলডিন থেকে অন্তত ২ কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে।

আগুন লাগার পরও কিলডিনের নাবিকেরা কারও কাছে সহায়তা চাননি। তাঁদের জাহাজের পেছনের ডেকে জড়ো হতে দেখা যায়। লাইফবোটও বের করছিলেন তাঁরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালান কিলডিনের নাবিকেরা। পরে ইঞ্জিন চালু করে জাহাজটি আবার যাত্রা শুরু করে।

পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার আগুন লাগা জাহাজটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থান করছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটির নানা ঘটনার ওপর নজর রাখছিল সেটি। এত দিন সিরিয়ায় টার্টাস বন্দর রুশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ডিসেম্বরে আসাদের পতনের পর সেখান থেকে নিজেদের সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে তারা।

দুই মাস আগেও এই অঞ্চলে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি ফ্রিগেট (একধরনে যুদ্ধজাহাজ) অ্যাডমিরাল গোর্শকভে আগুন লেগেছিল। এরপর কিলডিনের আগুন লাগল। এই দুই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে পশ্চিমা বিভিন্ন সূত্র যুক্তি দেখিয়েছে যে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রাশিয়ার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নড়বড়ে ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে।

এই সূত্রগুলো জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার কিলডিন যখন বিপদে ছিল, তখন রাশিয়ার আরও দুটি নৌযান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সাময়িক সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ভেসে ছিল। সেগুলো হলো অবতরণকারী জাহাজ ইভান গ্রেন ও আলেক্সান্ডার ওট্রাকোভস্কি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসে রুশ সামরিক বাহিনী বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান বলেন, রাশিয়ার নৌযানে এমন উপদ্রব নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ ধরনের ঘটনা যে শুধু ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, তা-ও নয়।

মাইকেল কফম্যান বলেন, যুদ্ধজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেগুলো প্রস্তুত রাখার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বহু আগে থেকেই রুশ নৌবাহিনী সমস্যার মধ্যে রয়েছে। রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজে অগ্নিকাণ্ড বিরল কোনো ঘটনা নয়। নিজেদের পুরোনো নৌযানগুলোকে নিয়ে নিঃসন্দেহে মাশুল গুনতে হচ্ছে রাশিয়াকে।

এখন সিরিয়ার নতুন শাসক হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) যদি মস্কোকে টার্টাস বন্দর ব্যবহার করতে না দেয়, তাহলে রাশিয়ার সমস্যা ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। যত দূর জানা গেছে, টার্টাস ও খমেইমিম বিমানঘাঁটিতে রাশিয়া এখনো সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাতে পারছে। কিন্তু রুশ বাহিনী যেহেতু বাশার সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছিল, তাই এই অনুমতি কত দিন থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।

গত সপ্তাহে টার্টাস বাণিজ্যিক বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০১৯ সালে রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা একটি চুক্তি বাতিল করেছে এইচটিএস। সিরিয়ায় রাশিয়ার নৌঘাঁটির জন্য এটি একটি অশুভ লক্ষণ বলে মনে করেন সিদ্ধার্থ কৌশল। সিদ্ধার্থ লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) সমুদ্র শক্তিসংক্রান্ত একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক।

টার্টাস বাণিজ্যিক বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হারানোয় রাশিয়ান নৌবহরের সমস্যাগুলো সংকটে পরিণত হবে বলে মনে করেন সিদ্ধার্থ। তিনি বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের পর রুশ নৌবাহিনীকে বাস্তবিক অর্থে টেকসইভাবে গড়ে তোলা হয়নি। দ্রুততার সঙ্গে তারা ছোট ছোট নৌযান তৈরি করেছে এবং সেগুলো বিপুল পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র বোঝাই করেছে। এই কৌশল নিজেদের উপকূলীয় জলসীমার প্রতিরক্ষার জন্য বেশ কার্যকরী। কিন্তু দূরবর্তী স্থানে যত ছোট নৌযান পাঠানো হবে, রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা তত প্রকট হবে।

Comments (0)
Add Comment