‘গুগল পে’: পাকিস্তানে খুলল দুয়ার, বাংলাদেশে বাধা কোথায়?

দেশে বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্ত ফ্রিল্যান্সাররা সহজে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে এখনও বাধার সম্মুখিন হচ্ছে। কারণ দেশে এখনও চালু হয়নি গুপল পে। অথচ এদিক থেকে এগিয়ে গেছে পাকিস্তান। দেশটিতে বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) থেকে এটি চালু হয়েছে; যা গুগল পের বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

পাশাপাশি, পাকিস্তান বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ফ্রিল্যান্স মার্কেট হিসেবে পরিচিত, যেখানে ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশনের চাহিদা ব্যাপক। তাই এই বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম চালুর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা আরও সহজে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারবে।

পাকিস্তানের ফিনটেক ও ব্যাংকিং খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, যা গুগল পের প্রবেশকে সহজ করেছে। ব্যাংক এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের ফলে ব্যবহারকারীরা আরও সুবিধাজনক ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ পাচ্ছে।

গুগল পে এবং পেপাল কি কাজ করে?

গুগল পে মূলত একটি ডিজিটাল ওয়ালেট এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, যা কন্টাক্টলেস পেমেন্ট (নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন বা এনএফসি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পয়েন্ট অফ সেলস মেশিনে ফোন টাচ করেই পেমেন্ট করা যায়), অনলাইন শপিং, পিয়ার-টু-পিয়ার (পিটুপি) ট্রান্সফার এবং বিল পেমেন্টের সুবিধা প্রদান করে। সেই সাথে রিওয়ার্ড এবং ক্যাশব্যাক সুবিধা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, আরেকটি বৈশ্বিক ওয়ালেট ও অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা ‘পেপাল’ মূলত আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার ও অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে, যা ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং এবং ব্যবসায়িক লেনদেনে ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে গুগল পে সীমিতভাবে কার্যকর, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক কার্ডের মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা যায়। তবে পেপাল সরাসরি বাংলাদেশে কাজ না করলেও, তাদের সহযোগী পরিষেবা জুম (Xoom) ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সাররা কিছুটা লেনদেনের সুবিধা পায়।

পেপাল বাংলাদেশে কেন কাজ করতে পারছে না?

পেপাল বাংলাদেশে না থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিমালা এখনো পেপালের মতো ফ্রিল্যান্সার বান্ধব গ্লোবাল পেমেন্ট সিস্টেমের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয় বা পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশের ডিজিটাল লেনদেন পর্যবেক্ষণ কাঠামো এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। ফলে পেপাল বাংলাদেশের বাজারে আসতে রাজি নয়। এটি সাধারণত এমন বাজারে কাজ করে, যেখানে তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেনের সুযোগ থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ তুলনামূলক কম। যার কারনে বাংলাদেশে কম মুনাফা অর্জনকারী দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

গুগল পে বা পেপাল বাংলাদেশে চালু হলে কি সুবিধা পাওয়া যাবে?

যদি বাংলাদেশে গুগল পে বা পেপাল চালু হয়, তাহলে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এটি বড় সুবিধা নিয়ে আসবে। আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম গুলোতে এখন কাজ পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই ফ্রিল্যান্সাররা ব্যক্তিগতভাবে ইউটিউব বা লিংকডইনের মাধ্যমে যে কাজগুলো পাচ্ছে সেগুলোর বৈদেশিক আয় গুগল পে, পেপাল, অ্যাপল পে প্রভৃতির মত বৈশ্বিক ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে দেশে আনতে পারছে না।

তাই এ ধরনের বৈশ্বিক ডিজিটাল ওয়ালেটের আগমন আন্তর্জাতিক পেমেন্টকে সহজ করবে, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ব্যাংক ফি কমাবে এবং টাকা দ্রুত তোলা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, ই-কমার্স ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে, যা দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে সহায়ক হবে। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে (ইবে, আমাজন, এটসি ইত্যাদি) ব্যবসা করতে পারবে। সাধারণ মানুষের জন্যও সুবিধা বৃদ্ধি পাবে, কারণ রেমিট্যান্স আসা সহজ হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিষেবার সাবস্ক্রিপশন ফি পরিশোধ করা সহজ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্ৰস সেটেলমেন্ট) ও এনপিএসবি (ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ) বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে অন্য দেশের পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য এপিআই ভিত্তিক ইন্টিগ্রেশন দরকার। যদি পেপাল বা গুগল পে আসে, তাহলে তারা স্থানীয় পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হবে, যা আন্তর্জাতিক লেনদেনকে সহজ করবে। ভারত ইতোমধ্যে ইউপিআই (ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস) চালু করেছে, যা নেপালে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ যদি ইউপিআই বা অন্য কোনো আন্তঃদেশীয় ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে পারে, তাহলে আসিয়ান অঞ্চল ঠিক যেভাবে ‘নেক্সাস পেমেন্ট’ সুবিধা তাদের সদস্য দেশগুলোর জন্য চালু করতে যাচ্ছে, ঠিক সেই রকম কাছাকাছি সুবিধা হয়তো বা এই ধরনের প্রযুক্তি ভিত্তিক সংস্থার সহায়তায় আমরা সার্ক অঞ্চলেও গড়ে তুলতে পারি।

অন্ততপক্ষে নগদবিহীন (cashless) অর্থনীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। তাছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুধু যে প্রথাগত ব্যাংকগুলো সুবিধা পাবে তা নয়, মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোও সুবিধা পেতে পারে। অধুনা পাকিস্তানে মিশরের ইউনিকর্ন কোম্পানি, এমএনটি-হালান ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয় এই বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ এশিয়ায় ১০০টি শাখা খুলতে আগ্রহী যাদেরকে বাংলাদেশের মাইক্রো ফাইনান্স কোম্পানিগুলো ব্যবহার করতে পারে, বিশেষ করে ডিজিটাল ঋণ প্রদানে।

বাংলাদেশে পেপাল বা গুগল পে আনতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার নীতিমালায় পরিবর্তন প্রয়োজন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

গুগল পে বা পেপালের বিকল্প চ্যানেল কি ব্যবহার করা সম্ভব?

ফ্রিল্যান্সিং আয় দেশে নিয়ে আসার জন্য কিছু ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে, যারা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পেপাল, গুগল পে বা অ্যাপল পের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করার সুবিধা দিচ্ছে এবং তা কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থানীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা সম্ভব।

এ ধরনের পরিষেবা সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে কাজ করে। কিছু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক একাউন্ট ব্যবহার করে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে, এরপর তা স্থানীয় ব্যাংক বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে স্থানান্তর করে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল কারেন্সির মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন করে টাকা স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ক্রিপ্টোকারেন্সিকে পুরোপুরি বৈধতা দেয়নি, তবে ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।

এই ধরনের ফিনটেক পরিষেবার অন্যতম সুবিধা হলো: সহজ সাইন-আপ প্রক্রিয়া সম্পাদন, ফ্রিল্যান্সাররা তাদের সেবা সংক্রান্ত ইনভয়েস তৈরি করে গ্রাহকদের পাঠাতে পারেন যার ভিত্তিতে গ্রাহক সহজেই পেমেন্ট প্রদান করতে পারেন, সরাসরি ব্যাংকে টাকা পাঠানোর সুবিধা, দ্রুত আন্তর্জাতিক লেনদেন‌ এবং নিরাপদ লেনদেনের নিশ্চয়তা।

সেই সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নিয়ম-কানুন।‌ যেহেতু পেপাল বাংলাদেশে নেই তাই তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে কি নীতি গ্রহণ করে সেটাও দেখার বিষয়। ফিনটেক প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত বৈধতা ও লেনদেনের স্বচ্ছতা খতিয়ে দেখতে হবে। আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে তারা উচ্চ সার্ভিস চার্জ‌ আরোপ করতে পারে। ‌ ‌

সবশেষে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় পেপাল, গুগল পে অথবা তাদের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মাইক্রো ফাইন্যান্স গুলোর সাথে যদি কাজ শুরু করে, তাহলে দেশের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে এবং ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্স খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নীতিমালা, আন্তর্জাতিক মানের সাইবার নিরাপত্তা এবং ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকরী সমন্বয়।

মোঃ সাইফুল আলম তালুকদার

বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি

 

Comments (0)
Add Comment