গার্ডার দুর্ঘটনা: ক্রেন চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী

রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেটকারের উপর নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে একই পরিবারের ৫ সদস্য নিহতের ঘটনায় ঘাতক ক্রেন চালক ও সহকারী এবং নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীসহ ১০ জনকে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। অদক্ষ হেলপার ৭০ টনের গার্ডার তুলছিল ৫০ টনের ক্রেন দিয়ে। ক্রেনটি ছিল অনেক পুরোনো এবং ছিল না ফিটনেস। বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, গত ১৫ই আগস্ট রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দিন রোডে বিকাল আনুমানিক সোয়া চারটায় নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে একটি প্রাইভেট কারের উপরে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। দুর্ঘটনার পরবর্তীত দ্রুততম সময়ের মধ্যে র‌্যাব সদর দপ্তরের Rapid Response Team ও র‌্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ৪ ঘন্টাব্যাপী উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। এসময় র‌্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উঁচু করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধারে সহায়তা করা হয়। ওই দুর্ঘটনায় ভিকটিম পরিবার রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় অবহেলাজনিত কর্মকান্ড দ্বারা মৃত্যু ও গুরুতর জখমের সংঘটনের অপরাধে ১টি মামলা করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ১৭ই আগস্ট রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১,৩,৪,৬ এবং র‌্যাব-১২ এর যৌথ অভিযানে ক্রেন চালক মো. আল আমিন হোসেন হৃদয় (২৫), হেলপার রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেড এর সত্ত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) এবং মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে (২৯) রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালসী, সাভার এবং গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাট এর বিভিন্ন এলাকায় পৃথক অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে। এর আগে রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেট কারের ওপর নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের যে ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের ৫ জন মারা যান সেই ক্রেনটির ছিল না ফিটনেস।

ক্রেনটি ছিল অনেক পুরাতন। এর ধারণক্ষমতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টন। আর গার্ডারের ওজন ছিল ৬০ থেকে ৭০ টন। গার্ডার তোলার কাজ করার সময় দুটি ক্রেন থাকার কথা থাকলেও ছিল একটি। যে ক্রেনটি ছিল সেটিও ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এছাড়া থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার তুষার ক্রেনের ভাড়া, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। রুহুল ২০১০ সালে এবং তুষার ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ প্রদান করে। এছাড়াও এই ক্রেনের ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানির (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রকল্পের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালীন এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক/অপারেটর মো. আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী গ্রেপ্তার হওয়া ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ওঠানামার জন্য ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত রুবেল তিন মাস আগে ও আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিকম্যান হিসেবে এ প্রকল্পে যোগ দেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন এই র‌্যাব কর্মকর্তা।

Comments (0)
Add Comment