ভারতের জনপ্রিয় লেখক এবং অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যার উল্লেখযোগ্য অংশটুকু মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
-এত হুমকি, আপনার লেখায় প্রভাব পড়ে?
অরুন্ধতী রায়: হুমকি সব সময় থাকে। এখন লেখককে প্রতিটি শব্দ লেখার আগে বার বার ভাবতে হচ্ছে। বাক্স্বাধীনতা নেই। এতে সংস্কৃতির ক্ষতি হচ্ছে, মুক্ত চিন্তা থমকে যাচ্ছে। লেখক হিসেবে আমাদের কাজ প্রশ্ন করে তাতিয়ে তোলা, যে কোনও বিষয় নিয়ে কাটাছেঁড়া করা। অথচ, সব কিছু পিছন দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীই হোন বা অন্য পেশার মানুষ, বোকার মতো কথা বলছেন।
-‘আজাদি’ লেখা পোস্টার হাতে দাঁড়ানোয় একটি মেয়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। নেতারা তো যা খুশি বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন।
অরুন্ধতী রায়: কেউ বলছেন, প্রতিবাদীদের গুলি করে মারতে। কেউ বলছেন, পোশাক দেখে চেনা যায়। কেউ বলছেন, পাকিস্তানে চলে যাও। উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদ হচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রী বললেন, প্রতিশোধ নেয়া হবে। লোকের থেকে পয়সা উসুল করা হবে। হচ্ছেও। যুদ্ধক্ষেত্রের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি। ডাক্তার চিকিৎসা করতে চাইছেন না। বুলেটবিদ্ধ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষ পুলিশের হাতে মার খেয়েও হাসপাতালে যাচ্ছে না। ভয়, চিকিৎসা পাবে কি না, তার ওপর যদি দেশদ্রোহিতার চার্জ দেওয়া হয়! যেখানে বিজেপির শাসন, সেখানে গুজরাট তৈরি করতে চাওয়া হচ্ছে। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি। এখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কৌশলটা এ রকম, একজন আক্রমণাত্মক হয়ে বলবেন, অন্যজন চুপ। এখনও সেটাই হচ্ছে। এই মুহূর্তে একটা লেখার মধ্যে রয়েছি। লেখার সময় একটা অন্য রকম হয়। দেখতে পাই, একটা একটা করে জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে— জানালা খোলো! যেভাবেই হোক।
-দেশ জুড়েই মোদিবিরোধিতা, কিন্তু বিজেপি তো জনগণের ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে!
অরুন্ধতী রায়: ভোটে জেতা দিয়ে সব কিছুর বিচার হয় না। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় গলদ রয়েছে। অম্বেদকরের ‘পুনে অ্যাক্ট’ এর নীতিকে খারিজ করা হয়েছিল সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখতে। নয়ত নির্বাচন জেতা কঠিন হত। সেই সময়ও কিন্তু সরকার সবার মনের মতো ছিল না। আজকের প্রতিবাদ শুধু এনআরসি, সিএএ’র বিরোধিতা নয়। অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চশিক্ষার অবনতি, বেসরকারিকরণ— পরিস্থিতি ভয়াবহ। নির্বাচন তো ঢের দেরি। তত দিনে দেশের অবস্থা এতটাই বিগড়ে যাবে যে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে না।
-রাজনীতিতে আসার কথা ভেবেছেন?
অরুন্ধতী রায়: একেবারেই না। লেখকের ভূমিকাটা উল্টো বলেই আমার মনে হয়। মনে হয়, অপ্রিয় কথাগুলো কে বলবে? কেউ বড় সিনেমা বানালে তাকে চুপ থাকতে হয়, কারণ তিনি ব্যবসা করে খাচ্ছেন। বলিউডের বেশিরভাগ মানুষ তাই চুপ। এমন লেখকও আছেন। কিন্তু আমি নিজের কাজটা ভুলতে পারি না। অনেকে মনের মধ্যে সেন্সরশিপ তৈরি করে বসে আছেন। ক্ষমতাতোষণের বাইরে বেরিয়ে কথা বলার সাহস নেই। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা।
-আপনার লেখায় সমকালীন রাজনীতির বয়ান কী ভাবে তৈরি হয়?
অরুন্ধতী রায়: ফিকশন আমায় রাজনীতি শিখিয়েছে। গড অব স্মল থিংস এর চরিত্র রাজনীতি বুঝতে শিখিয়েছে লেখার ধাপে ধাপে। আবার দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস লিখছি যখন, তখনও ভাবিনি, এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যেতে হবে! কখনও কখনও ভয় লাগে, যা আমি আগে লিখেছি, এখন হুবহু ঘটছে। কাশ্মীরে গিয়ে দেখি, সব ব্যবসা শেষ হতে বসেছে। রিসার্চ স্কলার কাজ করতে পারছেন না। পর্যটন বসে গিয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ। প্রশাসন বলে কিছু নেই। মনে হচ্ছিল, এই সরকার যদি কাশ্মীরে এনআরসি চায়, কী হতে পারে। ওখানকার মানুষ তো বলবেন, নাগরিকত্ব চাই না! তখন?