তখন গ্রীষ্মের দুপুর। কয়েকজন কৃষক পেঁপে ভর্তি টুকরি মাথায় নিয়ে কৃষি খামার থেকে ফিরছিলেন। ঘামে ভেজা চর্বিহীন শরীর মধ্যাহ্নের রোদে ঝলমল করছিল। কিছু কৃষক মাঠের ফসল তুলছিলেন। পেঁপে, করলা, শশা, মরিচ, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি ফসলে ভরে আছে তাদের খামার। পরদিন ফসল পৌঁছাতে হবে হাটে, সেজন্য মাঠে কৃষক ব্যস্ত। এখন বছরের সারা মৌসুম কৃষকেরা ব্যস্ত থাকেন।
কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর আগেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপন্ন এ এলাকায় ফসল হতো না। লবণাক্ত এবং শুষ্ক মাটিতে আবাদ হতো না। শুধু বর্ষাকালের ধান আবাদ ছিল একমাত্র ভরসা। বর্ষাকালেও ধান আবাদের জন্য কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করতেন। মিঠা পানির অভাবে বছরের অধিকাংশ সময় ফসলি জমি পতিত থাকত। এলাকার মানুষ জীবিকার জন্য কাজের সন্ধানে শহরে যেতেন। তখন এলাকায় খাদ্যাভাব ছিল। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্থানীয় কৃষক সেই অবস্থা পুরোপুরি উল্টে দিয়েছেন। তারা জোট বেঁধেছেন এবং সমাধান খুঁজে বের করেছেন।
কৃষক হেমায়েত উদ্দিন (৩৭), গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিলেন উপার্জনের জন্য। তিনি আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, আমরা বংশ পরম্পরায় কৃষিকাজ করেছি। কিন্তু এক সময় লবণাক্ততা এবং মিঠা পানির অভাবে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায়। জীবন জীবিকার জন্য যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শহরের কঠিন কাজে আমি অভ্যস্ত না। এলাকায় কৃষি পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় এখন আমাকে শহরে যেতে হয় না। আমরা প্রাকৃতিক বিপদের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।
কৃষকদের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগের এই গল্পটি বাংলাদেশের উপকূলীয় কুমিরমারা গ্রামের। এটি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়ন কাউন্সিলের আওতাধীন একটি গ্রাম। কুমিরমারা গ্রামের কৃষক হেমায়েত উদ্দিন একা নন, আরো বহু কৃষক কাজের জন্য শহরে যেতে বাধ্য হতেন। কিন্তু এখন নিজ গ্রামেই এই এলাকার কৃষকদের কর্মসংস্থান হয়েছে। একই দৃশ্যপট চোখে পড়ে কলাপাড়া উপজেলার নিকটবর্তী বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া গ্রামে। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামের কৃষকেরাও লবণাক্ততা মোকাবিলার জন্য চাষাবাদের ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন।
সমুদ্র থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে সওদাগরপাড়া গ্রাম, অপরদিকে পদ্মা গ্রাম সমুদ্র থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রের খুব নিকটে হওয়ার কারণে এই তিনটি গ্রামই বহুমূখী প্রাকৃতিক বিপদের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ গ্রামগুলোতে দৃশ্যমান। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, ঘন ঘন সাইক্লোনের প্রভাবে গ্রামগুলোতে কৃষির সংকট দিন দিন বাড়ছিল। কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
সমাধান খুঁজে বের করেছেন কৃষকেরা
পানি ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ কৃষকদের কাছে যাওয়ায় কৃষির অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। দলবদ্ধ হয়ে কৃষকেরা সমস্যা সমাধান করছেন। কুমিরমারা এবং নিকটবর্তী অন্যান্য গ্রামের কৃষক মিঠা পানির অভাবে জমি চাষ করতে পারতেন না। সল্যুশনের অনেক কষ্টে মিঠা পানি সংগ্রহ করলেও লবণ পানিতে ফসল নষ্ট হয়ে যেত। কৃষকেরা সম্মিলিতভাবে এই দুটি সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেছেন। গ্রামের একটি মিঠা পানির আবদ্ধ খাল দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে ছিল। প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে ওই খাল প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল মুক্ত করেছেন কৃষকেরা। এই খাল থেকে এখন তারা জমি আবাদের জন্য মিঠা পানি সংগ্রহ করতে পারছেন। অন্যদিকে এলাকার সব খালের স্লুইজগেট ছিল প্রভাবশালীদের দখলে। স্লুইজ গেট থেকে আসা নদীর লবণ পানি কৃষি জমি প্লাবিত করত। কৃষি জমিকে লবণ পানি মুক্ত রাখতে এলাকার সব খালের স্লুইজগেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন কৃষকেরা।
দূরের খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে শুকনো মাটিতে সবজি চাষ শুরু করেছিলেন কুমিরমারা গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন। ২০১৩ সালে বিদেশে অবস্থানরত এক আত্মীয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথমে ছোট আকারের কৃষিতে তার খরচ হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা। বছর শেষে তিনি লাভ করেন প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ফলে জাকির হোসেন কৃষিতে আরো উৎসাহিত হন। প্রতি বছর তিনি চাষাবাদের জমির পরিমাণ বাড়ান। এখন তিনি ২০০ ডিসিমেল জমিতে আবাদ করেন।
তখন জাকির হোসেন একা। নিকটবর্তী সব জমি তখন ছিল অনাবাদী। চাষাবাদ করতে গিয়ে জাকির হোসেন লবণ পানি এবং লবণ মাটির সাথে যুদ্ধ করেছেন। অনেক কষ্টে মিঠা পানি সংগ্রহ করে জমি আবাদ করেছেন। জাকির হোসেনের চাষাবাদ লাভজনক হওয়ায় এলাকার অন্য কৃষকেরাও অনুপ্রাণিত হন। এবং তার সাথে যোগ দেন আরো অনেক কৃষক। এরপরে শুরু হয় দলবদ্ধভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা।
পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে একদিন কুমিরমারা গ্রামের কয়েকজন আলোচনায় বসেছিলেন। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল এলাকার কৃষির সংকট চিহ্নিতকরণ এবং সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা। পরপর কয়েকটি সভা করে সমস্যা সমাধানের জন্য তারা কৃষক সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেন। সমিতির নাম রাখা হয় ‘নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক সমিতি’। প্রথমে অল্প কয়েকজন কৃষক নিয়ে এই সমিতি গঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে সমিতির সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। সমিতির সদস্য সংখ্যা এখন ১৬২জন। তবে এখন সমিতির উদ্যোগে গোটা ইউনিয়নের প্রায় ৮ হাজার কৃষক কৃষির আওতায় এসেছে।
নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক সমিতি’র সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘বহুমূখী সংকটের মধ্যে এক সময় আমরা উত্তরণের পথ খুঁজি। কৃষি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আমরা এলাকার কৃষকেরা একত্রিত হয়েছিলাম। কৃষকের সম্মিলিত শক্তি আমাদেরকে আবার মাঠে ফিরিয়েছে। যে জমির কড়কড়ে মাটিতে ফসল হতো না, সেই জমিকে আমরা তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করেছি। প্রায় সারা বছর আমাদের এলাকা সবুজে ভরা থাকে।’
সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে বারবার লোকসানে পড়ছিলেন পাথরঘাটা উপজেলার (সাব-ডিষ্ট্রিক্ট) মৎস্যজীবী আবদুর রহিম (৪৮)। এ কারণে জমিতে কৃষি আবাদ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তীব্র লবণাক্ততার কারণে তার ফসল পুড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে লবণাক্ততা এড়িয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে তিনি আবাদ শুরু করেন। ভাসমান পদ্ধতি এবং মাচান পদ্ধতিতে সবজি আবাদ শুরু করেন তিনি। এতে সফলতা আসে। আবদুর রহিম এখন মাছ ধরা থেকে কৃষি আবাদে বেশি মনোযোগী। জলবায়ু সংকট এড়িয়ে জীবন জীবিকায় একটি সল্যুশন খুঁজে বের করেছেন আবদুর রহিম। তার এই সল্যুশন গল্পটা এখন গ্রামের অনেকেই অনুসরণ করছেন।
আবদুর রহিম বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আমাদের জীবনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। সমুদ্র-নদীতে আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক বিপদ আমাদের ঘিরে আছে। দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের জীবন জীবিকার জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।’
অনেক কৃষক পুনরায় গ্রামে ফিরেছেন
কুমিরমারা গ্রামের কৃষক নূরে আলম (৩৫), জীবিকার জন্য রাজধানী ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনি বর্ষাকালে ধানের আবাদের মৌসুমে এলাকায় ফিরে আসতেন। কিন্তু বছরের অন্য সময়ে তিনি শহরে বিভিন্ন কাজে উপার্জন করতেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরিবার এভাবে পরিচালনা করেছেন। কিন্তু নূরে আমার এখন এলাকায় ফিরে এসেছেন। নিজের জমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কুমিরমারা গ্রামের আরো অনেক মানুষ এলাকায় ফিরে এসেছেন, যারা এখন কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত।
কুমিরমারা গ্রাম থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরের গ্রাম সওদাগরপাড়া। কুমিরমারা গ্রামের মতো এ গ্রামেও শহরে কর্মজীবী মানুষেরা গ্রামে ফিরেছে কৃষিকাজের জন্য। এদের একজন নূর দারাজ (৩৪)। তিনি বলেন, ‘লবণ পানি, সেচের পানির অভাব ইত্যাদি কারণে আমাদের গ্রামে কৃষিকে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রামের অনেক লোক কাজের জন্য শহরে গিয়েছিল। আমি এলাকায় কাজ করে সংসার চালাতে পারছিলাম না। আমিও চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলাম উপার্জনের জন্য। ৯ বছর আগে আমি গ্রামে ফিরে এসে কৃষি কাজে যুক্ত হয়েছি।’
সওদাগরপাড়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম (৩৬) বলেন, ‘লবণ পানির কারণে আমরা বারবার ধান চাষ করে ক্ষতির মুখে পড়েছিলাম। চাষাবাদের জন্য মিঠা পানি পাওয়া যায় না। মাঠে খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। অনেক খাল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে রেখেছে। পরে ধান আবাদের বদলে সবজি আবাদ শুরু করেছি। পাশের খাল থেকে আমরা সেচের জন্য মিঠা পানি পাচ্ছি।’
সওদাগরপাড়া গ্রামের শতাধিক কৃষক শহর থেকে এলাকায় ফিরে এসে চাষাবাদ শুরু করেছে, যারা উপার্জনের জন্য শহরে গিয়েছিল। জলবায়ু সংকটাপন্ন এই এলাকায় কৃষি আবাদ করে এখন কৃষকেরা সাবলম্বী। অনেক কৃষক আবাদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করছে, যা তাদের পরিবারকে সাহায্য করছে।
জলবায়ু অভিযোজনের একটি দৃষ্টান্ত
বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, গত দুই দশকে চরম আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ঘন ঘন সাইক্লোন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপদ বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এবং সেচের পানির অভাবে কৃষিও পড়েছে হুমকির মুখে। ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ লোককে শহরের বস্তিতে বা বিদেশে বাস্তুচ্যুত করেছে।
কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখেও মরিয়া হয়ে জাকির হোসেন, আবদুর রহিম, নূরে আলম এবং আরো অনেক কৃষক নিজের মাটিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ন্যাচার-বেজড সল্যুশনের মাধ্যমে কৃষক নিজেই জলবায়ু অভিযোজনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) চূড়ান্ত করেছে। এই ডকুমেন্ট বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজনে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান (এনবিএস) এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন অভিযোজন (এলএলএ) গাইড করবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
কৃষি গবেষক মিস্টার রবিউল আলম বলেন, ‘জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কৃষকদের এই উদ্যোগ আমাদেরকে সল্যুশনের পথ দেখায়। কৃষকদের সম্মিলিত উদ্যোগে এলাকার কৃষি চিত্র বদলে গেছে। বহু কৃষক জীবন জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভর করছে। কৃষকদের এই ধরণের উদ্যোগ এগিয়ে নিতে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকদের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে বাংলাদেশের বৃহৎ উপকূলরেখায় বেড়িবাঁধ বাড়াতে হবে এবং শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য আমামাদের বিলিয়ন বিলিয়ন খরচ করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব মোকাবিলা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলায় উপকূলীয় বেল্টে ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং প্রশমনের জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বরাদ্দকৃত ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত ‘কিছুই’ পায়নি।’