কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে কেউ কারও হবে না। প্রত্যেকেই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করতে থাকবে। এমনকি বিভীষিকাময় সেই দিনে বাবা-মা, সন্তান-সন্ততিরও হুঁশ থাকবে না কারও।
পবিত্র কুরআনে কিয়ামত দিবসের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও তার বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও তার সন্তান-সন্ততি থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেদিন কিছু কিছু চেহারা উজ্জ্বল হবে। সহাস্য, প্রফুল্ল। আর কিছু কিছু চেহারার ওপর সেদিন থাকবে মলিনতা। (সুরা আবাসা, আয়াত: ৩৪-৪০)
সেদিন বান্দার আমলেই নির্ধারণ হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা জান্নাত নাকি জাহান্নাম। আর হাশর-নশরে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সাক্ষ্য দেবে। পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘যেদিন তাদের জিহ্বাগুলো, তাদের হাতগুলো ও তাদের পাগুলো তারা যা করত, সে ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। সেদিন আল্লাহ তাদেরকে তাদের ন্যায্য প্রতিদান পুরোপুরি দিয়ে দেবেন, আর তারা জানবে যে, আল্লাহই সুস্পষ্ট সত্য। (সুরা নূর, আয়াত: ২৪-২৫)
তবে কিয়ামতের সেই বিভীষিকাময় দিনেও নবীজি (সা.) উম্মতদের পাশে থাকবেন। মহান রবের অনুমতিসাপেক্ষে উম্মতদের জন্য তিনি শাফায়াত বা সুপারিশও করবেন। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমিই হবো বনী আদমের সরদার। এতে কোনো অহংকার নেই, আমার হাতেই থাকবে হামদের পতাকা, এতে কোনো অহংকার নেই; আদম এবং অন্যান্য সকল নবীই ওইদিন আমার পতাকার নিচে থাকবেন। আমিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি মাটি বিদীর্ণ করে উঠব, এতে কোনো অহংকার নেই। (সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস: ৪৩০৮)
নবীজি (সা.) আরও বলেছেন- ওইদিন মানুষ তিনবার ভীষণ ভীতিকর অবস্থায় পড়বে। তারা আদম (আ.) এর কাছে আসবে, আর বলবে- আপনি আমাদের আদি পিতা আদম, আপনি আমাদের জন্য আপনার প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন। আদম আ. বলবেন- আমি তো একটা ভুল করেছিলাম, যার কারণে আমাকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। বরং তোমরা নূহ (আ.) এর কাছে যাও। পরে সবাই নূহ (আ.) এর কাছে আসবে। তখন নূহ আ. বলবেন- আমি তো পৃথিবীতেই একটি দোয়া (প্রত্যেক নবীর জন্য বরাদ্দ বিশেষ দোয়া) করেছিলাম। এতে তারা ধ্বংস হয়েছে। তোমরা বরং ইব্রাহিম (আ.) এর কাছে যাও। পরে সবাই ইব্রাহিম (আ.) এর কাছে আসলে তিনি বলবেন- আমি তো তিনটি অসত্য কথা বলেছিলাম। রাসুল (সা.) বলেন- মূলত ওই তিনটি কথার একটিও মিথ্যা ছিল না। আসলে আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবেই তিনি তা করেছিলেন। যা হোক, ইব্রাহিম আ. বলবেন- তোমরা বরং মুসা (আ.) এর কাছে যাও।
পরে সবাই মুসা (আ.) এর কাছে গেলে তিনি বলবেন- আমি তো একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলাম। তোমরা বরং ঈসা (আ.) এর কাছে যাও। এরপর সবাই ঈসা (আ.) এর যাবে। ওইসময় অন্যদের মতো তিনিও বলবেন- আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে উপাসনা করা হয়েছে। তোমরা বরং মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে যাও। নবীজি (সা.) বলেন, এরপর সবাই আমার কাছে আসবে। আমি তাদের সঙ্গে চলব।
নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, এরপর আমি জান্নাতের দরজার আংটা ধরে তা খট-খটাবো। বলা হবে কে? উত্তরে বলা হবে- মুহাম্মাদ (সা.)। আমার জন্য জান্নাতের দ্বার তারা (ফিরিশতারা) খুলে দেবেন এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে বলবেন- মারহাবা, এরপর আমি (রাব্বুল আলামিনের হুজুরে) সিজদায় লুটিয়ে পড়ব। আল্লাহ্ তা’য়ালাই আমাকে হামদ ও ছানার ইলহাম করবেন। আমাকে বলা হবে- আপনার মাথা তুলুন। যাঞ্ছা করুন, আপনাকে তা দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। আপনি বলুন, আপনার কথা শোনা হবে। (সুনান আত তিরমিজি, হাদিস: ৩১৪৮)
এ ক্ষেত্রে নবীজির শাফায়াত লাভে সবচেয়ে ভাগ্যবান কে হবে, সে বিষয়েও হাদিসে বর্ণনা এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো- ইয়া রাসুলাল্লাহ! (সা.) কিয়ামতের দিন আপনার শাফায়াত লাভে কে সবচাইতে বেশি ভাগ্যবান হবে? জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, আবু হুরায়রা! আমি ধারণা করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার আগে আমাকে আর কেউ প্রশ্ন করবে না। কারণ, আমি দেখেছি হাদিসের প্রতি তোমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত লাভে সবচাইতে ভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি, যে খালিস দিলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ (পূর্ণ কালেমা তাইয়্যেবা) বলে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯)
এ ক্ষেত্রে আজান শুনে দোয়া পড়লেও আখিরাতে নবীর (সা.) শাফায়াত লাভের অধিকারী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি আজান শুনে এই দোয়া করে- ‘হে আল্লাহ, এ পরিপূর্ণ আহ্বান ও সালাতের প্রতিষ্ঠিত মালিক, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওয়াসীলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন এবং তাঁকে সে মাকেমে মাহমুদে পৌঁছিয়ে দিন, যার অঙ্গীকার আপনি করেছেন’- কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি আমার শাফায়াত লাভের অধিকারী হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮৭)
তবে ৩ শ্রেণির হতভাগা রয়েছে যারা নবীজির (সা.) শাফায়াত বা সুপারিশ পাবেন না। কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে একাধিক বর্ণনা এসেছে।
আল্লাহর সঙ্গে শরিককারী
আল্লাহর সঙ্গে শরিককারী নবীজির (সা.) শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবেন। কারণ, শিরক সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ। খোদ মহান রাব্বুল আলামিন এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন। ‘নিশ্চয়ই শিরক মহা জুলম।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৩)। অপর আয়াতে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরি করেছে ও মুশরিকরা, জাহান্নামের আগুনে থাকবে স্থায়ীভাবে। তারাই হলো নিকৃষ্ট সৃষ্টি।’ (সুরা বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৬)
আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হাদিসে, রাসুল (সা.) বলেছেন, একবার জিবরাঈল (আ.) আমার কাছে এসে সুসংবাদ দিলেন যে, আপনার উম্মাতের যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরিক না করে ইন্তেকাল করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি (নবীজি সা.) বললাম, যদিও সে যিনা করে এবং যদিও সে চুরি করে। তিনি (জিবরাঈল আ.) বললেন- হ্যাঁ, যদিও সে ব্যভিচার ও চুরি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৪)
জালিম বা অত্যাচারী
কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে জালিমরা নবীজির (সা.) শাফায়াত পাবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি (নবীজি সা.) তাদের আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দিন। যখন তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে দুঃখ, কষ্ট সংবরণ অবস্থায়। জালিমদের জন্য নেই কোনো অকৃত্রিম বন্ধু, নেই এমন কোনো সুপারিশকারী যাকে গ্রাহ্য করা হবে।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ১৮)
অপর আয়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আর জালিমরা শিগগিরই জানতে পারবে কোন প্রত্যাবর্তন স্থলে (জাহান্নাম) তারা প্রত্যাবর্তন করবে (সুরা আশ-শু’আরা, আয়াত ২২৭)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘জালিমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি, যার লেলিহান শিখা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে গলিত শিশার ন্যায় পানি দেয়া হবে, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, কতই না নিকৃষ্ট পানীয়! আর কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল! (সুরা কাহাফ, আয়াত: ২৯)
দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তনকারী
যারা দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন করে নতুন কিছু অন্তর্ভুক্ত করে কিয়ামতের দিনে তারা নবীজির (সা.) শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবেন। সাহল ইবনু সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- (কিয়ামতের দিন) আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাওসারের কাছে পৌঁছব। যে ব্যক্তি আমার কাছে পৌঁছবে, সে তার পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে (হাউজে কাউসারের পানি), সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।
নবীজি আরও বলেন, সেদিন আমার কাছে এমন কিছু লোক আসবে, যাদের আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মধ্যে আড়াল করে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, তারা তো আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে তারা যে কি সব নতুন নতুন মত-পথ তৈরি করেছে। তা শুনে আমি বলব, যারা আমার অবর্তমানে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে, তারা দূর হোক (অর্থাৎ এ ধরনের লোক রাসুল সা. এর শাফায়াত ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে)। (মেশকাত, হাদিস: ৫৫৭১; সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৩৪)