সেলাই সম্বল করে নারীদের স্বনির্ভর করে তুলেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার কাঁথাস্টিচকে। ২০২৩ সালের পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত পশ্চিমবঙ্গের সুচিশিল্পী প্রীতিকণা গোস্বামী৷দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের নয় নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ৬৭ বছরের প্রীতিকণা।
শুধু বাংলা বা ভারতের সীমানায় আবদ্ধ থাকেননি, বিদেশেও তার শিল্পকীর্তি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই নাম ছড়িয়ে পড়ার আগে যে নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্যে তার অস্তিত্বের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা একজন শিল্পীর সাধনাও বটে৷ কমলা দেবী কাঁথা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রীতিকণা বছরের পর বছর ধরে তৈরি করছেন বহু ছাত্রীকে, যারা তারই শিল্পকে দেশান্তরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
প্রীতিকণা বলেন, ‘আমি খুব সাধারণভাবেই ছা্ত্রীদের সঙ্গে মিশি, গল্প করি। উৎসাহিত করে বলি, দেখো আমি যদি পারি, তাহলে তোমরাও পারবে। তোমরাও পুরস্কারের জন্য কাজ করো। ইতোমধ্যে তারা ভাল কাজ করছেও।’
বাংলাদেশের বরিশালে পূর্বপুরুষের ভিটে প্রীতিকণার। তার ঠাকুমা ছিলেন সেলাইয়ে সোনার পদক জয়ী। ঠাকুমার সেসব কাজ তাকে উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জন্মানো প্রীতিকণার কাঁথা এমব্রয়ডারি শিল্পে তেমন জ্ঞান ছিল না। এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় হাতেখড়ি হয় তার।
সংসারের দুর্দিনে এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরেন উপার্জনের পথ হিসেবে। এভাবে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। পরে ক্রাফ্টস কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর একটি কাঁথাস্টিচের কাজ ১৭টি বিনিদ্র রাত জেগে শেষ করেন।
এমন একাগ্রতা দেখানোয় এরপর ক্রাফ্টস কাউন্সিল তাকে একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে বলে। প্রীতিকণা বিভিন্ন জাদুঘর ঘুরে বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর কাজ শিখেছেন এবং সে সব শিখিয়েছেন। বহু নারীর জীবন ও জীবিকা সুষ্ঠুভাবে চালানোর দায়িত্ব পালন করে এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই সুচিশিল্পীর অনাড়ম্বর, সাধারণ বাঙালি জীবনে দারিদ্র্য, অবহেলা ছিল নিত্যসঙ্গী।
বড় মেয়ে মহুয়া লাহিড়ির কথায়, ‘আমাদের দেশে শিল্পী, কারিগরদের শ্রদ্ধা, সম্মান, পারিশ্রমিক অনেক কম৷ ছোটবেলা থেকে আমরা দারিদ্র্য দেখে বড় হয়েছি। তার উপর তেমন সম্মানও জোটেনি। এমনকি ২০০১ সালে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার পরও আমার মাকে প্রতিবেশীরা আলাদা চোখে দেখেনি। বরং আমার কিংবা বোনের মা হয়েই তিনি আটকে থেকেছেন একটা নির্দিষ্ট পরিচয়ের গণ্ডিতে।’
মহুয়া দেশের অগ্রণী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজিতে ডিজাইনার হওয়ার পরে সম্মান পেয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে। পাশাপাশি দেখেছেন, তার মা সেই সম্মান ও সম্মানী পাননি।
মহুয়ার ভাষায়, ‘এ জন্যই ছোটবেলা থেকে এই কাজ আমাকে কোনোদিন আকৃষ্ট করেনি। অথচ মা চাইতেন আমি মায়ের পরে এই কাজটা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দেই। পরে আমি বিদেশে দেখেছি আমার মায়ের কাজ অন্য অনেকের থেকে বহু গুণ বেশি ভাল। তখন বুঝেছি মায়ের উত্তরসূরি হিসেবে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।’
সেই প্রচেষ্টাতেই প্রীতিকণার কাজ আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে মেয়ের হাত ধরে। মহুয়া বলেন, ‘কাঁথাস্টিচের শিল্প বাংলার এক প্রাচীন ও পারম্পরিক শিল্প। অথচ তার শিল্পীদের সে মূল্যায়ন হয় না। তার ঐতিহ্য বজায় রাখতে, শিল্পীরা যাতে সাম্মানিক পান সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ শুরু করি।’
মেয়ের হাত ধরে নতুন পথ চলাতে খুশি হয়েছেন প্রীতিকণা। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা তথা ভারতের নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি কালামের হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার নেওয়ার পর পদ্মশ্রী সম্মান তার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বাংলার মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য আরও উদ্যম পেয়েছেন।
সহাস্য মুখে সোনারপুরের পদ্ম পুরস্কার জয়ী ‘সেলাই দিদিমণি’ জানান, ‘প্রথমে অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করেছি। পরে পুরস্কার পেয়ে বুঝেছি তার গুরুত্ব। তবে বয়সের ভার রয়েছে, পুরস্কার প্রাপ্তিতে আরও অনেক দায়িত্ব জুড়ে গেল।’