নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম সংকট তৈরি করেছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউনের জের ধরে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষত ও বিশ্বমন্দা। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১২ লাখ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। যার মাথাপিছু পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৬০০ ডলার। অর্থাৎ করোনা মহামারীতে ধনী-গরিব, তরুণ-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ অন্তত ১ হাজার ৬০০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতির শিকার হবে। করোনায় সম্ভাব্য এ ক্ষতির পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি পশ্চিমের ধনীদের চাপের মুখে ফেলবে। তবে তাদের এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠাটাও তুলনামূলক সহজ হতে পারে। যদিও এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নশীল ও উন্নয়নকামী দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষের পক্ষে এ ধাক্কা সামাল দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। কেননা এশিয়া-আফ্রিকার অনেক মানুষের বার্ষিক আয় ১ হাজার ৬০০ ডলারের বেশ কম। তাদের রীতিমতো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে অর্থনৈতিক এ ক্ষত।
সম্ভাব্য পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও মোজাম্বিকের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এ দুই দেশের মানুষের বার্ষিক আয় ১ হাজার ৬০০ ডলারের কম। এখন করোনার ক্ষত এ দুই দেশের মানুষের জীবনযাপনের লড়াইকে আরো জোরদার করে তুলতে পারে। তাদের আরো প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে করোনা পরিস্থিতি। সম্ভাব্য এ অর্থনৈতিক ক্ষত আগামী দিনগুলোয় তাদের অনেককেই প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
আইএমএফ বলছে, বিষয়টা এমন নয় যে কোনো বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ১ হাজার ৬০০ ডলার করে সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। তবে করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন, জীবিকা, ক্রয়ক্ষমতা থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে ধাক্কা লেগেছে, যে অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে; তা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। প্রত্যেকের ঘাড়ে এ চ্যালেঞ্জের বোঝা গিয়ে পড়বে। বিশ্বজুড়ে সবাইকে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। বেশির ভাগ মানুষের মাথাপিছু আয় কমবে। এভাবেই মাথাপিছু ১ হাজার ৬০০ ডলার ক্ষতির প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বের ১৭০টি বা প্রায় ৯০ শতাংশ দেশকে নিম্ন মাথাপিছু আয়ের সংকটে ভুগতে হতে পারে। এর আগে আমরা কখনই এত বেশি দেশকে একসঙ্গে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে দেখিনি।
সম্ভাব্য এ সংকটের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিকভাবেই মহামারীর পর বিশ্বজুড়ে অসাম্য অনেক বেড়ে যাবে। খাদ্য, আবাসস্থল, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সমাজ—সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসবে। বিষয়টি অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভূমিকা অনুধাবন করতে হবে। দেশগুলোর মধ্যে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা দেখা দেবে। ফলে বিশ্বায়নের নাটকীয় পতন রোধে আমাদের আগেভাগেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে ইন্টারনাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) নাগাদ বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে। একই সময়ে করোনা সংকটে বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটির বেশি মানুষ স্থায়ী কর্মসংস্থান হারাতে পারে। বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় সম্ভাব্য এ কর্মসংস্থান সংকট চরম আকার ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
আইএলওর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে কর্মবাজারে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়তে পারে স্বল্প দক্ষতার কাজে নিয়োজিত কর্মী ও শ্রমিকরা। অনেক দেশে স্বল্প আয় করা নারী শ্রমিকরা ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে পারে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ বিশ্বজুড়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে (যেমন উবার চালক, কৃষি শ্রমিক প্রভৃতি) নিয়োজিত ২০০ কোটি মানুষ ও বিভিন্ন দেশের বস্তিতে বসবাসরত ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ কাজ হারাতে পারে। কিংবা তাদের আয় কমে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, করোনা সংকটের কারণে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রায় ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে বলে আগেই পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া আগে কখনই বৈশ্বিক অর্থনীতি এত বড় সংকোচনের মুখোমুখি হয়নি।
এএফপি, আরব নিউজ ও সিএনবিসি অবলম্বনে