এক লহমায় বঙ্গবন্ধুকে চেনাজানা

দাউদ হায়দার

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সময়ে এবং আগে-পরে কত বই প্রকাশিত; অজানা। কিছু কিছু জানা। বেরিয়েছে নানা প্রকাশন থেকে। লেখককুলের কেউ কেউ পরিচিত। কেউ অল্প; কেউ হালের। প্রত্যেকের বই সংগ্রহ অসম্ভব। বিভুঁইয়ে আরও। প্রত্যেক পাঠকেরই ভালো লাগা, পছন্দ-অপছন্দের নিজস্বতা আছে। রুচি আছে। ভাষার রুচি। গদ্যের রুচি। লেখনীর রুচি। এবং পাঠকের মেজাজমর্জি। কোন পাঠক কী ধরনের বইয়ে আগ্রহী, বলা দুস্কর।

বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রচারে কেন অনীহ, বলতে অপারগ। কোনো লাইব্রেরি নেই। দেশীয় সংস্কৃতির আয়োজন ছাড়া বাকি সবকিছু আছে। লন্ডন, দিল্লিও ধর্তব্য নয় যেন। কলকাতার উপদূতাবাসে একটি লাইব্রেরি আছে বটে, কিন্তু জরুরি বই পাওয়া দুস্কর। ইতিহাস, রাজনীতি, গবেষণা বইয়ের সংখ্যা এতই কম; প্রয়োজনমতো কিছুই পাওয়া যায় না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আরও অনীহা। কলকাতা-দিল্লিতে মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক ‘ট্রিপ’ করে; সরকারি অর্থে। ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল।

বছর পঁয়ত্রিশ আগে, পশ্চিম জার্মানির রাজধানী তখন বন; বাংলাদেশ দূতাবাস বন-এ। দূতাবাসের উদ্যোগে বাংলাদেশের চিত্রকলার বিশাল প্রদর্শনী জয়নুল আবেদিন থেকে সাম্প্রতিক। একই প্রদর্শনী বার্লিনে। একটি বড় চিত্রগৃহে। দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। সব দর্শকই জার্মান; বিদেশি। মিডিয়ায় বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে প্রতিবেদন, প্রশংসা।

ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের দূতাবাসে ‘কালচারাল’ বিভাগ আছে।

ভারতীয় দূতাবাসের অধীনে ‘টাগোর সেন্টার’ (পৃথিবীর নানা দেশে। যেখানে ভারতীয় দূতাবাস আছে), প্রতি মাসে বিস্তর প্রোগ্রাম। দর্শক-স্রোতা বিদেশি। ভারতীয় কালচারের প্রতি কেন আগ্রহ হবে না?

হিন্দি ভাষা শেখানোর জন্য সেন্টার, স্কুলও আছে। চীন আরও ব্যাপক স্তরে।

পৃথিবীর সপ্তম ভাষা বাংলা। ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের উচ্ছ্বাস, গদগদে স্বভাব উথলে ওঠে। ‘বাংলার জন্যে বিশ্বে মাতৃভাষা দিবস।’ বাঙালি-ছাড়া বিশ্বের কোন দেশ মাতৃভাষা দিবস পালন করে? কতজন জানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা’ দিবস? এইডস দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস ইত্যাদি রমরমা।

বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস, মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে কেন সোচ্চার হয় না, অনুষ্ঠানাদি করে না? করলে বাংলা ভাষারই প্রচার, বাংলার সংস্কৃতির নানা দিক উন্মোচন।

দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে উদ্যোগী হতেন। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী মৃত্যুর বছরখানেক আগে এ রকমই বলছিলেন একবার। ফোনে। বলেছিলুম, ‘তাঁর কন্যার দায় কম নয়।’

‘তোমাকে উদ্ৃব্দত করে লিখব।’ বলেন। একদম নয়। বলি।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীই বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকেই নানা দিক উন্মোচন করে লিখবেন। তোমার-আমার হয়তো অচেনা। তবে সবদিকই যে ঐতিহাসিক; না-ও হতে পারে। ভেজালও থাকবে।

একটি বিষয় লক্ষ্য করবে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। তাঁর জীবনচরিত, সংগ্রাম, দেশিকতা, মানবিকতা মূল্যায়নে বাঙালির অখণ্ডতার নিদর্শন তিনি। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ হয় না, বাঙালির স্বাধিকার হয় না। আমরা ভাগ্যবান, তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত ‘জয় বাংলা’।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা দিক উন্মোচন।’ নিশ্চয় বহু লেখক উন্মোচন করেছেন। পড়া হয়নি।

ভারত উপমহাদেশে তিনজন রাষ্ট্রনেতাকে নিয়ে বিস্তর গ্রন্থ প্রকাশিত। মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বঙ্গবন্ধু।

জিন্নাকে নিয়ে পাকিস্তানে। কিছু বইয়ে অতিরিক্ত গালগল্প আছে। ইতিহাসের বদলে অনৈতিহাসিক কেচ্ছা। পাকিস্তানেরই একজন ঐতিহাসিক, জিন্নাহ গবেষকের মুখে শুনেছি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ রকম এখনও শুনিনি কোনো গবেষক, ঐতিহাসিকের বয়ানে।

সম্প্রতি হাতে এসেছে মোশারফ হোসেন ভূঁইয়ার ‘মুজিব চিরঞ্জীব’। জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ। কৌতূহল হলো লেখক সম্পর্কে জানার। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা : বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র সচিব। আমেরিকায় লেখাপড়া। ডিগ্রিধারী। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদে পদাধিকার। দায়িত্বপ্রাপ্ত। কেউকেটা। দূতাবাসেও রাষ্ট্রদূত। জেলও খেটেছেন।

ফ্ল্যাপেই উল্লেখ, কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ, প্রতিটি বই বহুল বিক্রীত, প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশের মজিবর রহমান খোকার সগর্ব উচ্ছ্বাস।

মোশারফের ‘মুজিব চিরঞ্জীব’ বইয়ের (জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ) চৌত্রিশ বিষয়। ছোট-বড়। যেহেতু ছোট-বড়, সব বিস্তারিত না হলেও বঙ্গবন্ধুকে এক লহমায় চেনাজানা, বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য পরিস্কার। লেখকের মুনশিয়ানা।

মোশারফকে ধন্যবাদ, কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা প্রকাশিত করেছেন। আওয়ামী লীগের (হালের) প্রোপাগান্ডায় বলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকা, বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শন। আসলে আ স ম আবদুর রবই প্রদর্শক, তুলে ধরেন। নিজেও উপস্থিত ছিলুম। দেখেছি।

মোশারফের ‘মুজিব চিরঞ্জীব’-এ বহু তথ্য সংশোধিত। মোশারফ আমলা। ওঁর ইংরেজি লেখা পড়িনি। শুদ্ধাশুদ্ধ অজানা। বাংলায় পোক্ত নন। অশুদ্ধ।

‘সাথে’ বাংলায় অচল। যদিও পূর্ববঙ্গে ‘সাথে’ বহুল প্রচলিত। শুদ্ধ ‘সঙ্গে’। ‘সখ্যতা’ ভুল বাংলা। লিখেছেন। ‘মুজিব চিরঞ্জীব’ ভুলে ভরা নয়। সকলেরই পাঠ্য। মোশরফকে ধন্যবাদ।

দাউদ হায়দার: কবি

Comments (0)
Add Comment