এক-চতুর্থাংশ মানুষ ২০২২-এর আগে টিকা পাবে না

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ ভাগে চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমিত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এরপর পুরো বিশ্ব ওলটপালট করে দিয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। এরই মধ্যে বৈশ্বিক আক্রান্ত ৭ কোটি ৩৫ লাখ ছাড়িয়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৬ লাখের বেশি মানুষ। প্রথম শনাক্তের এক বছর পেরোনোর আগেই বিশ্বে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এতে দ্রুত মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশাবাদ তৈরি হয়েছে। তবে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোর ঠিক নিচে যেমন অন্ধকারের অবস্থান, তেমনি আশার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে হতাশার সম্ভাবনা। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালের আগে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ করোনার ভ্যাকসিন পাবে না। খবর ফোর্বস।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের গবেষণা বলছে, ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে চরম বৈষম্যের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো এগিয়ে থাকবে। যদিও এসব দেশের জনসংখ্যা তুলনামূলক কম।

প্রতিষ্ঠানটির নীতি বিশ্লেষক র্যাচেল সিলভারম্যান বলেন, ২০২০ সালজুড়ে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা দেখেছে বিশ্ববাসী। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল ভ্যাকসিনের অগ্রিম বুকিং নিয়েও। স্বাভাবিকভাবে এতে এগিয়ে রয়েছে ধনী দেশগুলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রয়োগ ও ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে ভ্যাকসিনের ৪৮টি প্রকল্প। প্রতিটি কোম্পানি যদি পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে তবে ২০২১ সালে ৫৯৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি ধনী দেশ এরই মধ্যে ৭৪৮ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের অগ্রিম বুকিং দিয়ে রেখেছে। যদিও আগামী বছর নাগাদ বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত অর্ধেকের বেশি (প্রায় ৫১ শতাংশ) ভ্যাকসিন উচ্চ আয়ের দেশগুলোর হাতে যাবে। এসব দেশ বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।

মেডিকেল ট্রেড জার্নাল বিএমজেতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটি এরই মধ্যে ৮০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের বুকিং দিয়ে রেখেছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা সম্মিলিতভাবে ১০০ কোটি ডোজের বেশি ভ্যাকসিন মজুদ করবে। অথচ এ তিনটি দেশে কভিড-১৯ রোগীর সম্মিলিত শনাক্তের সংখ্যা বৈশ্বিক শনাক্তের ১ শতাংশের কম। যদিও শনাক্ত ও মৃত্যু দুই তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

র্যাচেল সিলভারম্যান বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করছে। কাজেই যে দেশ আগে বুকিং দেবে, অর্থ পরিশোধ করবে, সেই দেশ আগে ভ্যাকসিন পাবে। ধনী দেশগুলো অনেক আগেই ভ্যাকসিনের অগ্রিম বুকিং সম্পন্ন করে রেখেছে। সেই তুলনায় উন্নয়নশীল ও উন্নয়নকামী অর্থনীতির দেশগুলো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। তাই বলা হচ্ছে, ২০২২ সালের আগে বিশ্বের চারজনের একজন ভ্যাকসিন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাদের প্রায় সবাই ধনী দেশের বাইরের নাগরিক।

বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এর দামকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের একেকটি ডোজের দাম ৬ থেকে ৭৪ ডলারের মধ্যে। এর ফলে এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে তা কিনতে পারবে না। সরকারি ভর্তুকির জন্য অপেক্ষা করতে হবে তাদের। করোনা মহামারীকালে বেশির ভাগ দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। ভ্যাকসিন কিনতে গিয়ে এ চাপ আরো বাড়বে।

অক্সফামের হেলথ পলিসি ম্যানেজার অ্যানা ম্যারিয়ট বলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণের বিদ্যমান মডেলে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে আগামী বছর উন্নত বিশ্বের বাইরে কোটি কোটি মানুষ ভ্যাকসিন পাবে না।

ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে বৈষম্যের এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতিটি দেশ দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেবে, এটা অনুমেয়। তবে বৈশ্বিক মহামারী দূর করতে হলে সম্মিলিতভাবে চিন্তা করা ও উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ভ্যাকসিন পেতে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডব্লিউটিওর কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নশীল ও উন্নয়নকামী অর্থনীতির দেশগুলো সম্মিলিত বিনিয়োগের মাধ্যমে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

Comments (0)
Add Comment