রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের অবদান এখন বিশ্বস্বীকৃত। ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালিদের একার নয়, সারা পৃথিবীর। বিশ্বের সব দেশ ও জাতির। ২১ ফেব্রুয়ারি সব জাতির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দিন- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বায়ান্নর ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণেই জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত ১৯৩টি স্বাধীন দেশ দিবসটি পালন করে।
২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির প্রথম দাবি করা হয় ১৯৯৭ সালে। ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলার গফুরগাঁও উপজেলা থেকে এ দাবি ওঠে। সে বছর স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গফুরগাঁও থিয়েটার’ ওই দাবির পক্ষে শোভাযাত্রা বের করে। এলাকার বিভিন্ন দেয়াল, বাস ও ট্রেনে পোস্টার লাগায়। তার দুই বছর পর সংগঠনটির একুশের সংকলনেও স্লোগান ছাপে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই/ একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই’ (সূত্র : মাহবুবুল আলম কবীরের প্রবন্ধ, ১১ জানুয়ারি ২০১৩, দৈনিক কালের কণ্ঠ)।
এরপর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেওয়ার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক ছাত্র কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের প্রবাসী বাঙালি প্রয়াত রফিকুল ইসলাম (১৯৫৩-২০১৩) ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন জাতিসংঘের মহসচিব কফি আনানের কাছে একটি আবেদন করেন। এর জবাবে ২৩ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে কফি আনানের তথ্য কর্মকর্তা বাংলাদেশি হাসান ফেরদৌস জানান, একটি সংস্থার পক্ষ থেকে বিষয়টি ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করতে হবে। তাতে দাবিটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
কফি আনানের কাছে লেখা রফিকুল ইসলামের প্রথম আবেদনপত্রের একাংশ-
Bangali have played a very important role in protecting their MOTHER LANGUAE DAY from serious crisis related to its existence. In today’s world there are many nations and/of communities still facing serious crisis and threat against their ‘MOTHER LANGUAGE DAY’. In some cases, these languages are oppressed. All these need international support, all these need to be focused. Getting moral and emotional support from the organization like yours, could be a great help to demonstrate a wide range of respect and dignity to all the ‘MOTHER LANGUAGES’ of the world. … (সূত্র : কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস, তিতাস চৌধুরী, পৃ. ১৭০)।
তখন রফিকুল ইসলাম ও কানাডা প্রবাসী তাঁর আরেক সহযোগী আবদুস সালাম ‘A group of Mother Language Lovers of the World’ নামে একটি সমিতি গঠন করে। সাতটি ভাষার ১০ জন সদস্য এ সংগঠনে যুক্ত হন। এঁদের মধ্যে দুজন বাঙালি- রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম, দুজন ইংরেজ- জ্যাসন মোরিন ও সুসান হজিন্স, একজন জার্মান- রেনাটে মার্টিনস, দুজন ফিলিপিনো- অ্যালবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিন্টোবাল, একজন কুচি- নাজনীন ইসলাম, একজন ক্যান্ডোনিজ- ড. কেলভিন চাও এবং হিন্দিভাষী করুনাজোসি ছিলেন। এ সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের সাতটি ভাষায় লিখিত এবং দশ ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত আবেদন ইউনেস্কোতে জমা দেওয়া হয়।
আবেদনের প্রাথমিক জবাবে ইউনেস্কোর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ আনা মারিয়া ওই সমিতিকে জানায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। তবে কোনো সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
এরপর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ের শিক্ষা সচিব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে সচিব শিক্ষামন্ত্রী এস কে সাদেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মন্ত্রী বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করেন।
ঐদিকে রফিক ইসলাম ইউনেস্কো ভাষা বিভাগের প্রধান জোসেফ পল ও আনা মারিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকেন। আনা মারিয়া উৎসাহের সাথে সাড়া দিচ্ছিলেন। তাঁর পক্ষ থেকে পাঁচটি দেশের নাম উল্লেখ্য করে ওই দেশগুলোকে ‘A group of Mother Language Lovers of the World’-এর প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবের অনুরোধ করা হয়। পাঁচটি দেশ হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরি। এরপর ইউনেস্কো অফিস থেকে বলা হয়- দেশগুলোকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ করার দাবির পক্ষে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা এ সমর্থন আদায়ে যুক্ত হন। সবাই দিনরাত পরিশ্রম করে ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবের পক্ষে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের লোকজন ও প্রবাসীরাও বিষয়টি টের পেল না যে, আমাদের ‘একুশে’কত বড় অর্জনের দিকে যাচ্ছে।
১৯৯৯ সালের ৯ নভেম্বর ইউনেস্কোর কাছে প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। তখনো প্রস্তাব গিয়ে পৌঁছায়নি। রফিকুল ইসলাম ও সালাম চিন্তায় পড়ে গেলেন- মহান একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কি শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যাবে ! টেলিফোন সামনে নিয়ে বসে রইলেন দুজন। বারবার ইমেইল চেক করছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রস্তাবটি এখনো আসছে না। টানটান উত্তেজনায় সময় কাটছে রফিক ও সালামের। লিখিত প্রস্তাবটিতে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরটিই বাকী ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সংসদে। ওই দিকে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ সময় শেষে সেখান থেকে বেরিয়ে স্বাক্ষর করে ইউনেস্কোতে পাঠাতে পাঠাতে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাবে। রফিক ও সালামের তখন দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে- সব পরিশ্রম কি তাহলে বৃথা যাবে! প্রস্তাবটিতে দ্রুত স্বাক্ষর দিতে টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়। তিনি দ্রুতই প্রস্তাবটিতে সই করেন। এরপর ফ্যাক্স করতে হবে ইউনেস্কোতে। সময় মাত্র এক ঘণ্টার সামান্য বেশি বাকি। রফিক-সালামের শরীর থেকে ঘাম ঝড়তে শুরু করেছে এরইমধ্যে। অবশেষে সময় শেষ হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা পৌঁছাল ইউনেস্কো অফিসে। রফিক ও সালাম আপতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও ঘোষণার জন্য প্রহর গুনতে থাকলেন।
ফ্রান্সের প্যারিসে ১৬ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে বসে ইউনেস্কোর ৩০তম সম্মেলন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ এ প্রস্তাব উত্থাপিত হলো না সেদিন। অপেক্ষার দিন বাড়ল আরো একদিন। পরের দিন ১৭ নভেম্বর সভার শুরুতেই যৌথভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বাংলাদেশ এবং সৌদি আরব। অন্য পঁচিশটি রাষ্ট্রের সদস্যরা এটি অনুমোদন করেন। এমনকি বাংলাভাষাকে রাষ্টভাষা করার দাবি যে পাকিস্তান একদিন মানতে চায়নি, সেই পাকিস্তানও এ দাবির পক্ষে সমর্থন জানায়। ইউনেস্কোর বৈঠকে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনার পর ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ৩০তম সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ইউনেস্কোর প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। একুশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিকভাবে।
তারপর ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত ১৮৮ ( তৎকালীন জাতিসংঘ সদস্য সংখ্যা) দেশ একযোগে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মাতৃভাষার সম্মনার্থে বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর বাণীতে বলেন, ‘বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মুখে যখন কয়েকটি ভাষা বিশ্বভাষায় রূপ নিয়েছে, এটা প্রয়োজনীয় যে আমরা স্থানীয় ভাষার বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখি।’
লেখক : বাশার খান,
সাবেক নিউজরুম এডিটর, এটিএন নিউজ।