ইসরায়েলি সেনাদের বর্ণনায় গাজায় গণহত্যার ভয়াবহতা

বিবিসির প্রতিবেদন

ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা, শিশুদের হত্যা করা, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, সম্পদ চুরি করাসহ ইসরায়েলি সেনাদের বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের ভয়াবহ বর্ণনা উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যায় অংশ নেওয়া ইসরায়েলি সেনাদের একটি অংশ যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা দেখে ও যুদ্ধাপরাধের অনুতাপ থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করেছেন। গাজায় যেতে অস্বীকৃতি জানানো এসব সেনার বর্ণনায় উঠে এসেছে গাজায় ১৪ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ভয়াবহতা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ২৬ বছর বয়সী ইসরায়েলি যুবক ইউভাল গ্রিন। আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন রিজার্ভ মেডিক ছিলেন তিনি।

দেশ আক্রমণের মুখে, দেশকে রক্ষার চিন্তা থেকেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হামাসের কাছে জিম্মি ইসরায়েলিদের মুক্ত করাই ছিল তার প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান তার পুরোনো ভাবনায় নাড়া দেয়।

গাজায় তিনি একদিন দেখেন, রাস্তার মাঝে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ পড়ে আছে, কামড়ে খাচ্ছে কয়েকটি বিড়াল। ‘এ যেন কেয়ামত নেমে এসেছে। ডানে তাকান, বামে তাকান, ধ্বংসের লীলাখেলা দেখবেন শুধু। আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবন, ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হওয়া ভবন দেখবেন। এটাই গাজার বাস্তবতা,’ বলেন ইউভাল।

গণহত্যার ডাক : যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরই তিনি ইসরায়েলি বিভিন্ন কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মুখ থেকে গণহত্যার ডাক শুনতে পান। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ডেপুটি স্পিকার নিসিম ভাতুরি গাজা উপত্যকাকে ‘পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার’ আহ্বান জানান।

প্রখ্যাত ইহুদি ধর্মগুরু এলিয়াহু মালি গাজার ফিলিস্তিনিদের নিয়ে বলেন, ‘তুমি যদি তাদের হত্যা না করো, তারা তোমাকে হত্যা করবে।’

ইউভাল বলেন, ‘গাজার পুরো জনসংখ্যাকে হত্যার কথা বলা হচ্ছিল, যেন এটা বইয়ে থাকা কোনো স্বাভাবিক ধারণা। তাদের এসব কথা শুনে সেনারা গাজায় ঢুকেছে। (হামাসের হামলায়) তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন নিহত হয়েছে, আবার তারা অন্য সেনাদের মৃত্যুর খবরও শুনছে। (যে কারণে গাজায় প্রবেশ করে) তারা অনেক কিছু করেছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাদের দেওয়া পোস্টে অনেক যুদ্ধাপরাধের খবর উঠে এসেছে। আটক করা ফিলিস্তিনি বন্দিদের হেনস্তা, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা, দখলকৃত ঘরবাড়িতে প্রবেশ করে ফিলিস্তিনি নারীদের পোশাক পরে তাদের উপহাস করাসহ অনেক ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে।

ইউভাল বলেন, ‘আমি এসবের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব কথা বলা চেষ্টা করতাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, (ইসরায়েলি ক্যাম্পে) মানবতা বিবর্জিত, প্রতিশোধমূলক মানসিকতা বিরাজ করছিল।’

এই পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানান ইউভাল।

‘তারা একটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেয়। আমি আমার কমান্ডারকে গিয়ে প্রশ্ন করি, “এটা কেন করতে হবে?” জবাবে তিনি যে কথা বলেন, সেটা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া একজনের বাড়ি পোড়াতে রাজি ছিলাম না আমি। তাই আমি না করি এবং সেখান থেকে চলে আসি। এটা ছিল গাজায় ইউভালের শেষ দিন।

নির্যাতন মানে বাহাদুরি : ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ চিন্তাধারা থেকে যুদ্ধে যোগ দেওয়া আরেক সেনা বিবিসিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘(যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর) আমি বুঝতে পারি, ইসরায়েলিদের সুরক্ষার জন্য অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না। ‘

তিনি জানান, প্রায়শই সহকর্মীদের গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন করে সেটা নিয়ে বাহাদুরি করতে শুনেছেন তিনি।

‘তারা খুবই শান্ত কণ্ঠস্বরে (ফিলিস্তিনিদের) নির্যাতন, এমনকি খুন করার বর্ণনা দিত। যেন এটা কিছুই না।’

তিনি জানান, ফিলিস্তিনি বন্দিদের চোখ বেঁধে এমনভাবে রাখা হতো যেন তারা নড়াচড়া করতে না পারে। বন্দীদের যে খাবার দেওয়া হতো, সেটা দেখেও হতবাক হয়ে যান এই ইসরায়েলি সৈনিক। গাজায় প্রথম দফা দায়িত্ব পালন শেষেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আর কখনো সেখানে ফিরবেন না।

২৯ বছর বয়সী মাইকেল অফার-জিভ অপারেশন অফিসার হিসেবে একটি ব্রিগেডের যুদ্ধ কক্ষে কাজ করতেন। তার দায়িত্ব ছিল গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ড্রোন ক্যামেরায় উঠে আসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করা।

ক্যামেরা ফুটেজে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখলেও একদিন সশরীরে গাজায় গিয়ে তিনি ব্যাপক প্রভাবিত হন।

মাইকেল বলেন, ‘গাজার প্রধান কমান্ড থেকে বের হয়েছিলাম। রাস্তায় এক জায়গায় এসে গাড়ির জানলা খুললাম। একদলা মাংসের গন্ধ এসে নাকে লাগল। যেন মাংসের বাজারে চলে এসেছি।’

গাজায় শিশুহত্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, যুদ্ধ চলাকালে তার সহকর্মীদের বলতে শুনেছেন, ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধে যেসব শিশুদেরে আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারাই এখন সন্ত্রাসী হয়ে ৭ অক্টোবরের হামলাটি চালিয়েছে।

Comments (0)
Add Comment