কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে কর্মসূচি চলাকালে সারা দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট সেবা। এর পেছনে নানা অজুহাতও দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। প্রকৃতপক্ষে সে সময় সরকারি দুই সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিত। এমনকি তখনকার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকও ফোন করে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মঙ্গলবার এমনটাই জানিয়েছে দেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো। পত্রিকাটির ‘ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল বিটিআরসি ও এনটিএমসি, ফোন করেছিলেন পলকও’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি সে সময় সরকারি সংস্থাগুলোর কেউই স্বীকার করেনি; বরং নানা সময়ে নানা বক্তব্য দিয়েছিলেন জুনাইদ আহ্মেদ। তিনি সামনে এনেছিলেন ইন্টারনেট অবকাঠামোয় অগ্নিসংযোগের কথা। তবে কখন, কোন মাধ্যমে ও কোন সংস্থা ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল, তার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে গত ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট ও পরদিন ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল সব ধরনের ইন্টারনেট, যাকে বলা যায় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। পরে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল আরও পাঁচদিন। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন।
ওই প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে আরেক নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ইন্টারনেট বন্ধের জন্য বলা হয়।
পরদিন ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদও রয়েছেন। খুব কাছ থেকে করা পুলিশের গুলিতে তার নিহত হওয়ার ঘটনা মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে।
একইদিন দুপুরের দিকে বিটিআরসির একই বিভাগ থেকে দেশের ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ আসে। সঙ্গে উল্লেখ করা হয়, এই নির্দেশের ক্ষেত্রে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন রয়েছে।
১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো দিতে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিএমসি। সেদিন রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে এই সংস্থার পক্ষ থেকে মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়, তাদের আধেয় বা কনটেন্ট ‘ব্লকিং’ ও ‘ফিল্টারিং’ ডিভাইসের আওতার বাইরে থাকা ফেসবুক ও ইউটিউব দিবাগত রাত ১২টা থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। এর দুই ঘণ্টার মাথায় এনটিএমসি সব মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেয়। পরে এনটিএমসির নির্দেশনাতেই দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সচল হয়।
সবশেষ ২৮ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে এনটিএমসি থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়, ইন্টারনেট সচল হবে। তবে তার আগে অপারেটরদের ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, ইউটিউব, বিপ, সিগন্যাল, স্কাইপ ও বটিম বন্ধ করতে হবে।
এদিকে সাবমেরিন কেবল কোম্পানি ও আইটিসি সূত্রে জানা যায়, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বিটিআরসি ব্যান্ডউইডথ বন্ধের নির্দেশ দেয়। আইটিসি কোম্পানিগুলো লিখিত আদেশ চাইলে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হয়। রাত ৯টার মধ্যে পুরো দেশ ইন্টারনেট–বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত নজরদারি করে বিটিআরসি। সাবমেরিন কোম্পানিকে তখনকার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ নিজে ফোন করে ইন্টারনেট বন্ধের জন্য বলেন। ৫ আগস্টও সাবমেরিন কেবল কোম্পানি ও আইটিসি থেকে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল।
মূলত বিটিআরসি আইআইজিগুলোকেও ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে এবং ৫ আগস্ট বেলা ১১টা নাগাদ ইন্টারনেট বন্ধ করতে বলেছিলেন পলক। তবে আইআইজিরা জানিয়েছে, তারা ইন্টারনেট বন্ধ করতে গিয়ে দেখে আগেই ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইআইজিএবির মহাসচিব আহমেদ জুনায়েদ বলেন, এভাবে ইন্টারনেট বন্ধের কথা ভাবা যায় না। আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে রাজনীতিমুক্ত করে স্বাধীন কমিশন গঠনের জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।
এদিকে ইন্টারনেট সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশের ক্ষেত্রে দ্বিমত করা হলে লাইসেন্স বাতিলসহ নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হতো।