‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ যেভাবে এলো

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের মুখে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এই স্লোগান অনেক নেতা ব্যবহার করায় কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, স্লোগানটি দলীয় স্লোগান কিনা। তবে দল গঠনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ব্যবহার করতেন।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি কোথা থেকে এলো, তার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের এক লেখায়।

২০২২ সালের ২৯ মে ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯২১ সালে মাওলানা হাসরাত মোহানি (১৮৭৫-১৯৫১) প্রথম স্লোগানটি ব্যবহার করেন। এরপরে এ স্লোগান ঠাঁই করে নেয় উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিংয়ের কণ্ঠেও।

নানা পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন হাসরাত মোহানি। উর্দু ভাষার এ কবি ছিলেন শ্রমিকনেতা, ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও।

হাসরাত মোহানি ভারতের উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার মোহন নামের একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইরফান হাবিব লিখেছেন, জন্মের পর হাসরাত মোহানির নাম রাখা হয় ফজলুল হাসান। এ নামেই তিনি বেড়ে ওঠেন। একজন বিপ্লবী উর্দু কবি হিসেবে ‘হাসরাত’ ছিল তার কলমি নাম, যা একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও তাকে পরিচিতি দিয়েছিল। তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতার সঙ্গে প্রথম ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর হাসরাত মোহানি গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ভারতীয় সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক স্লোগানটি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এখনো দেয়। তিনি বাংলাদেশে অতীতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের এ স্লোগান দিতে শুনেছেন।

ইরফান হাবিবের লেখায় দেখা যাচ্ছে ১৯২৯ সালে আদালতে দেওয়া এক জবানবন্দিতে ভগত সিং বলেন, ইনকিলাব বা বিপ্লব বোমা বা পিস্তলের সংস্কৃতি নয়। আমাদের বিপ্লবের অর্থ হলো প্রকাশ্য অন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক জাফর আহমেদ ভূঁইয়া জানান, ইনকিলাব আরবি শব্দ। জিন্দাবাদ উর্দু শব্দ। মানে হলো ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি আরবি ও উর্দুর মিশেল। জিন্দাবাদ মানে অভিনন্দন জানানো। ফলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের মানে হলো বিপ্লবকে অভিনন্দন জানানো।

অবশ্য ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব তার লেখায় ইনকিলাব জিন্দাবাদের অর্থ হিসেবে লিখেছেন, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।

দেশে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত জুলাইয়ে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন তরুণদের অনেকেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ব্যবহার করেন।

জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এটি জাতীয় নাগরিক পার্টির দলীয় স্লোগান নয়। যেহেতু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি বেশ আলোচিত ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এখনো আমরা এই স্লোগানটি বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করছি।
আমাদের দলীয় স্লোগান ও মূলনীতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত আত্মপ্রকাশ, কমিটি প্রকাশ আর ঘোষণাপত্র হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো সামনে চূড়ান্ত করা হবে।

নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এই দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। তারা বলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে কারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম ঘোষণা করেন সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তবে আহ্বায়ক কমিটির একটি তালিকা পাওয়া যায়, যেখানে বিভিন্ন পদে ১৭১ জনের নাম রয়েছে।

নতুন দলের নেতাদের মুখে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।

জানতে চাইলে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক স্লোগানটি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এখনো দেয়। তিনি বাংলাদেশে অতীতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের এ স্লোগান দিতে শুনেছেন।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, স্লোগানটা তারা (ছাত্ররা) দিচ্ছে, সেটা কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দিচ্ছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা ক্লিয়ারলি (পরিষ্কারভাবে) বলে দিয়েছে তারা মধ্যপন্থী দল।

মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচয় প্রকাশ করে কিছু প্রতীক দিয়ে। দলের পতাকা থাকে, লোগো থাকে, স্লোগান থাকে।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, তাদের (অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র) মতে ৫ আগস্ট যদি একটি বিপ্লব হয়, সে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক—সেই সেন্সে (অর্থে) এ স্লোগান ঠিক আছে।

মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, জাসদ একসময় স্লোগান দিত বাংলার মেহনতি মানুষের জয় হোক, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিএনপি দেয়, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান। এখন এরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে, তো সেটা দেখা যাক….।

Comments (0)
Add Comment