প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক গোষ্ঠীর একটি প্রাচীনতম পর্ব থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে আধুনিকতা আসে, কিন্তু প্রাচীন প্রতিকৃতির একটি ছাপ রয়েই যায়।
আমাদেরও আছে এক আদিমতম ইতিহাস, আছে কল্পনাতীত ঐশ্বর্যে ভরপুর রাজ্যের কাহিনী। আর কাহিনীর শুরুটা হয়েছিলো ‘গঙ্গারিডাই’ নাম থেকে। হ্যাঁ, এটাই আমার, আপনার, আমাদের সবার আদিমতম পরিচয়। আমরাই সেই প্রাচীন ‘গঙ্গারিডাই’ এর অধিবাসী।
কি, নামটা অদ্ভূত ঠেকছে নাকি? আসলে ‘গঙ্গারিডাই’ নামটি প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা দিয়েছিলো। কারণ এটি মূলত গঙ্গা নদীর দুটি প্রবাহ- ভাগীরথী ও পদ্মার মাঝের ডেল্টা অঞ্চল। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা বিপাশা নদীর পূর্ব তীরে গড়ে ওঠা দুটি স্বতন্ত্র রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছিলো, যার একটি হলো ‘প্রাসিয়ই’ বা ‘প্রশিই’ বা ‘প্রাচ্য’ এবং অপরটি ‘গঙ্গারিডাই’। ‘গঙ্গারিডাই’-কে বিভিন্ন মতভেদে ‘গঙ্গারাষ্ট্র’, ‘গঙ্গাঋদ্ধি’, ‘গঙ্গারাঢ়’, ‘গঙ্গারিদুম’, ‘গঙ্গারাইডেস’, ‘গঙ্গারিডেই’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হতো।
‘গঙ্গারিডাই’ বা ‘গঙ্গারিডি’ শব্দটির উৎপত্তি ‘গঙ্গাহৃদি’ থেকে, অর্থাৎ, গঙ্গা হৃদয়ে যার, সে-ই ‘গঙ্গাহৃদি’ বা ‘গঙ্গারিডি’।
বলাই বাহুল্য, এখানে ‘গঙ্গা’ বলতে ভারতের ‘গঙ্গা’ নদীকে বোঝানো হয়েছে, যার একটি অন্যতম প্রধান অংশ বাংলাদেশের অধিকারে আছে এবং এটি ‘পদ্মা’ নামে পরিচিত। আবার, ‘গঙ্গাঋদ্ধি’ শব্দটির উৎপত্তি ‘গঙ্গার সমৃদ্ধি’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে করেন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক।
সমগ্র বাংলার ইতিহাস বলতে বোঝায়, ভারতবর্ষের যে যে অঞ্চল বাংলা ভাষাভাষী ছিলো সেসব অঞ্চলের ইতিহাস, অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার ইতিহাস। আর ভারতীয় ইতিহাসের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে বাংলার ইতিহাস।
প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে গঙ্গারিডাই ছিলো বাংলার একটি অন্যতম প্রাচীন জনপদ। গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস এর ‘ইন্ডিকা’ বইটিতে এই রাজ্যের কথা লেখা হয়েছে।
আমরা, অর্থাৎ বাংলার অধিবাসীরাই যে গঙ্গারিডাই এর পরিচয় বহন করি, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই এবং এটি মোটেও কোনো গাঁজাখুরি গল্প নয়। এর পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। মেগাস্থিনিস এর মতে, “গঙ্গা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত এবং গঙ্গারিডাই রাজ্যের পূর্ব সীমানায় সমুদ্রে মিলিত হয়েছে”। টলেমী বলেছেন, “গঙ্গা নদীর মোহনায় সমুদয় এলাকা জুড়ে গঙ্গারিডাই রাজ্য”। তিনি আরও বলেছেন, “গঙ্গার পাঁচটি মুখ সংলগ্ন প্রায় সমুদয় এলাকা গঙ্গারিডাইগণ দখল করে রেখেছিলো”। এছাড়া প্লিনিও লিখেছেন, “গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভেতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে”। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী গঙ্গার সবচেয়ে পশ্চিম এবং সবচেয়ে পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো গঙ্গারিডাই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব)’ বইটিতে লিখেছেন, “গঙ্গারিডাইরা-ই যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই, কারণ গ্রিক ও ল্যাটিন লেখকরা এ বিষয়ে একমত। ডিওডোরাস, কার্টিয়াস, প্লুতার্ক, সলিনাস, প্লিনি, টলেমি, স্ট্র্যাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক বিস্তৃত আলোচনা করে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় দেখিয়েছেন যে গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিলো”। এমনকি প্লিনি এ কথাও বলেছেন, “গঙ্গার দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ছিলো কালো এবং রৌদ্রে পোড়া, কিন্তু তারা ইথিওপিয়ানদের মতো কালো ছিলো না”।
গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভে কুষাণ রাজ্য ও পাঞ্জাবের শক-মুরুগুদের কথা পাওয়া গেছে। শক আর মুরুগু দুইটি আলাদা জনপদ। টলেমী মনে করেন, মুরুগু জনপদটি গঙ্গারিডাই এর পূর্বদিকে ছিলো।
ধারণা করা হয়, নন্দ বংশের গৌরব নাপিত কুমার মহাপদ্ম নন্দ প্রথমে ছিলেন প্রাচ্যের রাজা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি গঙ্গারিডাই-ও দখল করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে একই রাজার অধীনে প্রাচ্য-গঙ্গারিডাই যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো, যদিও দুই রাজ্যের আলাদা আলাদা সৈন্য-সামন্ত ছিলো। এই যুক্তরাষ্ট্রের রাজা মহাপদ্ম নন্দ অনেক শক্তিশালী রাজা ছিলেন, কারণ তার ১০০০ অশ্বারোহী, ৭০০ হস্তিবাহিনী এবং ৬০,০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে সজ্জিত সেনাবাহিনী ছিলো। এ কারণেই স্বয়ং দিগ্বীজয়ী ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ পরাজয় নিশ্চিত বুঝে বিপাশা নদী পার হয়ে আর পূর্বদিকে না এসেই ফিরে গিয়েছিলেন। এভাবেই তার ভারত অভিযান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
মহাপদ্মনন্দকে বলা হতো ‘ঔগ্রসৈনা’ বা ‘উগ্রসেনের পুত্র’। অধিকাংশের মতেই তিনি ছিলেন নিচু বংশজাত। পুরাণে তাকে ‘শুদ্র গর্ভ থেকে উদ্ভূত’ বলা হয়েছে। মহাপদ্ম নন্দ এতোটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, কোনো রাজ্যই তার সাথে বিরোধে যেতে চাইতো না এবং প্রাচ্য-গঙ্গারিডাই তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিলো। কিন্তু এই শক্তিও বীর চন্দ্রগুপ্তের (প্রথম চন্দ্রগুপ্ত) হাতের মুঠোয় চলে আসে একসময়। নন্দ রাজ্য ও এর সব সম্পদ তিনি দখল করে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হিউয়েন সাং সাক্ষ্য দিয়েছেন, মহাপদ্ম নন্দের সবচেয়ে ছোট ছেলে ধননন্দ গঙ্গার নিচে কোনো এক সুড়ঙ্গে প্রায় আশি কোটি সুবর্ণমুদ্রা লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ-ও জানা যায়, তার প্রায় নিরানব্বই কোটি সুবর্ণমুদ্রা ছিলো। এসব সম্পদের কিছুটা তিনি হয়তো বৈধ উপায়ে অর্জন করেছিলেন, কিন্তু এর বড় একটা অংশই তিনি অন্যায় ও অবৈধ উপায়ে লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে যদিও এই সব সম্পদ মৌর্যদের দখলে চলে গিয়েছিলো।
অধিকাংশের মতে, গঙ্গারিডাই এর রাজধানী ছিলো চন্দ্রকেতুগড় বা গাঙ্গে নগর। এটি ছিলো একটি দুর্গ নগর এবং বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। জ্যোতির্বিদ খনা ও মিহির এখানেই বসবাস করতেন এবং খনা-মিহিরের দুর্গটি আজও টিকে আছে। এই গাঙ্গে নগর সামুদ্রিক বাণিজ্যের এক বৃহৎ বন্দর ছিলো। কিন্তু অনেকেই আবার বলেন, গাঙ্গে নগর খুলনার কুমার নদীর তীরে অবস্থিত ছিলো, যা বর্তমানের সুন্দরবনের হরিণঘাটা নামে পরিচিত। এই রাজধানী বাণিজ্য নগরীটি সৌনাগড়া বা সোনাগড়া নামে পরবর্তীতে পরিচিত হয়। শুঙ্গ আমলেও গাঙ্গে বন্দরের অস্তিত্ব ছিলো, কিন্তু তখন বাংলার রাজধানী ছিলো পাটালিপুত্র। গাঙ্গে বন্দরে অতি সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র উৎপন্ন হতো এবং টলেমীর ধারণা, কাছেই কোথাও (নিম্নমধ্যবঙ্গে) সোনার খনি ছিলো। এখান থেকে দেশে-বিদেশে সোনা, মণি-মুক্তা, সূক্ষ্ম রেশম ও কার্পাস বস্ত্র, মসলা, গন্ধদ্রব্য ইত্যাদি রপ্তানি হতো।
সবার সুপরিচিত লেখক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এর ‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার’ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, উয়ারী বটেশ্বরই হলো গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমী বর্ণিত সৌনাগড়া বা সোনাগড়া বাণিজ্য কেন্দ্র, যা বর্তমানের বিক্রমপুর।
উয়ারী বটেশ্বর হলো বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বেলাব ও শিবপুর উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত ২৫০০ বছরের প্রাচীন একটি দুর্গ নগরী। এটি বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থল। প্রাচীনকালে এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিলো। এই কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সুদূর রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। এখানে বহু-ছাপাঙ্কিত রূপার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।
মনে করা হয়, গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার গঙ্গা নদীর পূর্ব তীরে যে বিশাল শক্তিশালী গঙ্গাঋদ্ধি জাতির কথা শোনেন, তারা ছিলো গঙ্গার তীরে বসবাসরত মানব বসতি, যেটা আজকের উয়ারী বটেশ্বর। এখানে স্বল্প মূল্যবান পাথর ও পুঁতি, বাটখারা প্রভৃতির বাণিজ্য হতো, যেগুলোর সাথে রোমান সাম্রাজ্যের পুঁতির অনেক মিল রয়েছে। হয়তো এখানেই ঐ পুঁতি নির্মাণের কারখানা ছিলো। এখান থেকে দেশে-বিদেশে সোনা, মণি-মুক্তা, সূক্ষ্ম রেশম ও কার্পাস বস্ত্র, মসলা, গন্ধদ্রব্য ইত্যাদিও রপ্তানি হতো। সে সময় যুদ্ধ ও যানবাহনের একটি অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিলো হাতি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম শিলালিপি মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে পাওয়া গিয়েছে। এটি মৌর্য যুগের, অর্থাৎ আনুমানিক ৩য় খ্রিস্টপূর্বাব্দের। শিলালিপিটির ভাষা মাগধী প্রভাবিত প্রাকৃত ভাষা। মৌর্য শাসন মগধকেন্দ্রিক ছিলো। এই লিপিটি পুন্ড্রবর্ধন তথা বাংলাদেশে মৌর্য শাসনের প্রাচীনতম সাক্ষ্য বহন করছে। আর মৌর্যদের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো। তার বহু প্রমাণ চন্দ্রকেতুগড় ও তাম্রলিপ্তি প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গিয়েছে।
বাংলাকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদী-নালা ছাড়াও বঙ্গোপসাগর বাংলাকে বাণিজ্য উপযোগী সুবিধাজনক যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ তৈরী করে দিয়েছে। প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো হলো, পুন্ড্রনগর বা মহাস্থানগড় (বাংলাদেশ); কোটিবর্ষ বা বাণগড় (পশ্চিমবঙ্গ); রামাবতী (পালরাজ রামপালের রাজধানী); সৌনাগড়া বা উয়ারী বটেশ্বর; সমন্দর বা চাটগাঁ (বাংলাদেশ); তাম্রলিপ্তি এবং চন্দ্রকেতুগড়। একজন গ্রিক নাবিকের ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিম্নভাগে ‘গাঙ্গে দেশ’ নামে একটি দেশ ছিলো। এর প্রসিদ্ধ পণ্যের মধ্যে ছিল তেজপাতা এবং সুগন্ধী তেল, যা রোমের অভিজাত ও বিত্তবান গোষ্ঠীর কাছে বিশেষ খ্যাত ছিলো।
বাংলার বস্ত্রশিল্প, বিশেষ করে মসলিনের জগৎখ্যাতি প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করা হয়েছে সুতিবস্ত্র মসলিনের। বাংলার অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিলো এই মসলিন। প্রাচীন বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎকর্ষ অবশ্য খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকের কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রেও লেখা আছে। পনেরো শতাব্দীর চীনা ভ্রমণকারী মাহুয়ানের বিবরণী হতে জানা যায়, বাংলার সাথে সুমাত্রা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিলো। মাহুয়ান বাংলায় আসেন ১৪০৬-১৪১৫ সালের মধ্যে। সে সময় তিনি প্রথম সুমাত্রা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছান এবং সেখান থেকে সোনারগাঁও যান। তখন দেশের মুদ্রা ছিলো প্রধানত রূপার। ছোটোখাটো ব্যবসার জন্য ছিল কড়ি।
বাংলা থেকে বিদেশে রপ্তানির জন্য পণ্য ছিলো- মসলিন, রেশম, সুতিবস্ত্র, চশম, গুবাক বা সুপারি, পান, মশলা, মোটাকাপড়, নীল, মহিষের শিং, সোরা (খনিজ পদার্থ), চাল, কুসুম, ঘি, মধু, তেল, ইত্যাদি। মালয় রাজ্য বা মালয়েশিয়াতেও এখান থেকে চাল রপ্তানি করা হতো। ইউরোপীয় ও আরবীয় বণিকরা বাংলায় জাহাজ নিয়ে এসে বাণিজ্য করেছেন এবং জাহাজ ভর্তি করে পণ্য বহির্বিশ্বে নিয়ে গিয়েছেন।
চাঁদ সওদাগর বাংলার নৌ বাণিজ্যের সংস্কৃতি, যদিও এটি একটি লোক কাহিনী। পর্তুগীজরাই প্রথম বাংলার সকল জলপথ আবিস্কার করে এবং তারাই সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে বণিকশ্রেণী হিসেবে আসা শুরু করে। ষোড়শ শতক থেকে বাংলার সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইতিহাস রচনা করা হয়েছে, কিন্তু তার আগেও সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিলো। সুলতানি যুগে আরব বণিকরা এসেছিলেন বাংলার চট্টগ্রামে। এসব সমুদ্র বাণিজ্য ইতিহাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের নতুন দিগন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা রাখা যায়।
বাংলা এতোটা সমৃদ্ধ ছিলো বলেই একের পর এক রাজবংশ বাংলা দখলের চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং মিশর থেকে শুরু করে চীন পর্যন্ত সবাই-ই বাংলার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে।
গঙ্গারিডাই তথা এই বাংলার রপ্তানিকৃত অর্থ দিয়েই রোমান সাম্রাজ্য প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়েছিলো এবং এই সাম্রাজ্যকেই পরবর্তীতে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দখল করে মৌর্য শাসনের সূচনা করেছিলো। সুতরাং, চন্দ্রগুপ্ত যে সাম্রাজ্য অধিকার করেছিলো তা তো বহু আগে থেকেই বিত্তশালী ছিলো। আর এই ধন-সম্পদের উৎস ছিলো আমাদের বাংলা। তাহলে প্রাচুর্যে ভরপুর এই বাংলার আজ এই ভগ্নদশা কেনো? কেনোই বা বিত্তশালী হওয়া আমাদের অঞ্চলের জন্য বাধা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আবারও ডুব দিতে হবে সুদূর অতীতে, আর খুঁজে বের করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে অদৃশ্য সেই শেকলকে।
গঙ্গারিডাই বা গঙ্গাঋদ্ধির ইতিহাস এতোটাই বীরত্বগাঁথায় পূর্ণ যে রোমান কবি ভার্জিলের স্বপ্ন ছিলো জন্মভূমি মালটুলায় ফিরে গিয়ে তিনি একটি মন্দির বানাবেন, যার চূড়ায় একটি স্বর্ণের গজদাঁতে গেঁথে দেয়া হবে গঙ্গাঋদ্ধির বীরত্বগাঁথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যে রাজ্য সর্বকালে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী ছিলো, তা ইতিহাস, পুরাণ, উপাখ্যান এবং ধর্মশাস্ত্রে আশ্চর্যরকমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত।
লেখক: চেয়ারপারসন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন।