আফগানিস্তানে ইসলামী স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন যে মসজিদ

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার শরিফে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য ইসলামী স্থাপত্যকীর্তি ‘নীল মসজিদ’। স্থানীয়ভাবে এটি ‘হজরত আলী (রা.)–এর মাজার’ বা ‘মাজার শরিফ’ নামেই বেশি পরিচিত। নীল টাইলস আর ফিরোজা গম্বুজে মোড়ানো এই ঐতিহাসিক মসজিদকে আফগানিস্তানের সবচেয়ে সুন্দর ও প্রতীকী ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে ধরা হয়।

ইতিহাস ও নির্মাণ

জনশ্রুতি আছে, দ্বাদশ শতকে বলখ প্রদেশের এক আলেম স্বপ্নে দেখেন যে, সেখানে হজরত ইমাম আলী (রা.)-এর দেহাবশেষ সমাধিস্থ আছে। তিনি বিষয়টি তৎকালীন সেলজুক শাসক সুলতান সানজার ইবনে মালিক শাহকে জানান। এরপর সুলতান সেখানে একটি মাজার নির্মাণের নির্দেশ দেন।

এই স্থানটিই পরবর্তীতে পরিচিত হয় ‘মাজার শরিফ’ বা ‘পবিত্র সমাধি’ নামে। এ নামেই গড়ে ওঠে আজকের শহরটি।

তবে প্রথম দিকের স্থাপনাটি বেশিদিন টেকেনি। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলদের আক্রমণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পর তিমুরীয় আমলে পুনরায় আবিষ্কৃত হয় স্থানটি।

পঞ্চদশ শতকে হেরাতের তিমুরীয় শাসক সুলতান হোসেন মির্জা বায়করার নির্দেশে নতুনভাবে নির্মাণ করা হয় বর্তমান মসজিদটি। তখন হেরাত, সমরখন্দ ও বুখারা থেকে সেরা কারিগর, স্থপতি ও টাইল শিল্পীদের এনে এই স্থাপত্যকীর্তি গড়ে তোলা হয়।

স্থাপত্য ও শৈল্পিক সৌন্দর্য

মসজিদটি চারদিকে সমানুপাতিক নকশায় নির্মিত, যা ইসলামী স্থাপত্যে স্বর্গীয় ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। চার কোণে উঁচু চারটি মিনার এবং মাঝখানে একটি বিশাল গম্বুজ দৃষ্টি কাড়ে।

বাইরের দেয়ালজুড়ে হাজারো টাইলস, আকাশি, ফিরোজা ও গাঢ় নীল রঙে। এর ভেতরে খচিত আছে কুফি ও সুলুথ লিপিতে কোরআনের আয়াত। সূক্ষ্ম জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশায় টাইলসগুলোর বিন্যাস এমন নিখুঁত যে, পুরো দেয়াল যেন এক বিশাল নান্দনিক ক্যালিগ্রাফির চিত্রপট।

গম্বুজগুলো দ্বিস্তরবিশিষ্ট, ভেতরে কাঠামোগত, বাইরে শোভামণ্ডিত। সূর্যের আলোয় নীল টাইলস ঝলমল করে ওঠে, আর রাতে চাঁদের আলোয় মসজিদটি যেন রুপালি আভায় জ্বলজ্বল করে।

ভেতরের অংশেও একই শৈল্পিক রুচি। মার্বেল কলাম, খোদাই করা কাঠের মিম্বার এবং সূক্ষ্ম কারুকাজে ঘেরা মিহরাব মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

আফগানদের বিশ্বাস, হজরত আলী (রা.)-এর লাশ এখানে সমাহিত। যদিও অধিকাংশ ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী তার মাজার ইরাকের নাজাফে অবস্থিত, তবু স্থানীয় এই বিশ্বাস মসজিদটিকে দিয়েছে গভীর ধর্মীয় মর্যাদা।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীল মসজিদ ছিল আলেম, সুফি ও ধর্মীয় জ্ঞানের শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল। এখানেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, নওরোজ উদযাপন।

মসজিদটি শুধু নামাজ ও ইবাদতের জায়গা নয়, বরং কোরআন শিক্ষা, হাদিস পাঠ ও ইসলামী  সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একসময় এটিকে বলা হতো ‘খোরাসানের আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয়।’

সংরক্ষণ ও আধুনিক পুনর্নির্মাণ

২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বড় আকারে মেরামত কাজের মাধ্যমে মসজিদটি নতুন রূপে ফিরে আসে। ২০০০ সালের পর আফগান সংস্কৃতি ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটিকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে কিছু টাইলস ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, ইউনেসকোসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় বর্তমানে পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে। লক্ষ্য—এর ঐতিহ্যবাহী শৈলী ও নান্দনিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা।

 জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

আজকের আফগানিস্তানে নীল মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। দেশটির ইতিহাসে যতই রাজনৈতিক অস্থিরতা আসুক, এই মসজিদ রয়ে গেছে শান্তি, ঐতিহ্য ও ইসলামী সৌন্দর্যের অনন্ত প্রতীক হয়ে।

সূত্র : আল জাজিরা