আট লেনের রিং রোড হচ্ছে ঢাকার চারপাশে, কমছে যানজট

রাজধানীর ওপর গাড়ির চাপ কমাতে এবার তৈরি হচ্ছে আউটার রিং রোড। আট লেনের বৃত্তাকার এই সড়কপথের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৩২ কিলোমিটার। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ইতোমধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। পনেরো হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে দুই পর্বে। ২০২৮ সালের মধ্যে এই সড়ক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দূষণের এই শহরে দিন দিন বাড়ছে নাগরিক সঙ্কট। এখন ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪০ থেকে ৪৭ হাজার মানুষ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যানজট। এই সমস্যা সমাধানে সরকার একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও প্রকৃত অর্থে মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। প্রশস্ত করা যাচ্ছে না ঢাকার সড়কগুলো। নষ্ট হয় লাখ লাখ কর্মঘণ্টা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম পর্বে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরানীগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত আট লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বর্তমানে চার লেনের ১২ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর সঙ্গে আরও চার লেন করা হবে। বাকি ৩৬ কিলোমিটার অংশ জমি অধিগ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আট লেন বিশিষ্ট এ সড়কের প্রস্থ হবে ২৪০ থেকে ৩০০ ফুট। এ অংশে ২টি রেস্ট এরিয়া, ৫টি ইন্টারচেঞ্জ, ৬টি সেতু, ২০টি ওভারপাস এবং আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে নির্মাণ করতে ৩৮৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ অংশের কাজ শেষ করতে ব্যয় হবে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে জি টু জি চুক্তিও হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্বে ৮৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ এবং উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান সড়কের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার ২ লেন এবং ৩৬ কিলোমিটার ৪ লেন করে রয়েছে। এসব সড়ক ৮ লেনে উন্নীত করা হবে। সেই সঙ্গে সরু সেতু ভেঙ্গে ৮ লেন বিশিষ্ট করা হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইন্টারচেঞ্জ, ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এ অংশের উন্নয়ন কাজ কিভাবে সম্পন্ন করা হবে, সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।

ঢাকাবাসীকে পদ্মা সেতুর কাক্সিক্ষত সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে আউডার রিং রোড বাস্তবায়ন জরুরী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের এমন পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই এখন জোরেশোরে প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সরকারের উর্ধতন পর্যায় থেকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে নিবিড় মনিটরিং করা হচ্ছে। খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায়ও (ড্যাপ) আউটার রিং রোড বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সে কারণে আউটার রিং রোডের প্রস্তাবিত নক্সার মধ্যে অন্য কোন ভূমি ব্যবহারের সুপারিশ রাখা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আউটার রিং রোডের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আরএসটিপির প্রস্তাবিত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে সওজ। ইতোমধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ শেষ হয়েছে। পিপিপিতে বাস্তবায়নে আগ্রহী জাপানের সঙ্গে জি টু জি চুক্তি করেছে সরকার। ২০২৮ সালের মধ্যে প্রকল্প উন্মুক্ত করার পরিকল্পনায় সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আশা করি, বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি চালু করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতু এবং দু’পারের ৫২ কিলোমিটারসহ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কেরানীগঞ্জ এলাকা দিয়ে আউটার রিং রোডের যে প্রস্তাব রয়েছে সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে সেতুর কাক্সিক্ষত সুফল পাবেন না ঢাকাবাসী। আউটার রিং রোড হলে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী মানুষ যার যার সুবিধামতো রিং রোড ব্যবহার করে চলে যাবেন। ভেবে দেখুন, যে লোক উত্তরা যাবেন, তার পোস্তগোলা ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি বছিলা বা গাবতলী এলাকা দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে বেড়িবাঁধ সড়ক ব্যবহার করে সে এলাকায় চলে যেতে পারবেন। অন্যান্য এলাকার যাত্রীও একইভাবে রিং রোডের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। তাহলে ঢাকার যানজট কমবে এবং অল্প সময়ে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারবেন।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আশীষ কুমার দে বলেন, পদ্মা সেতু এবং ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কারণে গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, বরিশাল এলাকার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করছে। এসব সম্ভাবনা কার্যকরভাবে কাজে লাগানো গেলে ওই এলাকার মানুষ ঢাকামুখী হবে না। প্রয়োজন থাকলে দিনে দিনে ঢাকায় এসে কাজ শেষ করে আবার চলে যাবেন তারা। এজন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকাকে ঘিরে রিং রোড করার যে পরিকল্পনা আছে, সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকার বাসযোগ্যতার জন্যও রিং রোডটি বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরী বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশে উপনীত করার ঘোষণা করেছে। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে রাজধানী ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য উন্নত দেশের ন্যায় সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। কেননা, অর্থনৈতিক উন্নতিসহ সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সড়ক নেটওয়ার্কের বড় ভূমিকা রয়েছে। ঢাকার যানজট নিরসনে সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ঢাকার চারদিকে ইনার রিং রোড ও আউটার রিং রোড নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইনার রিং রোর্ডের পূর্বাংশের ফিজিবিলিট স্টাডি করা হচ্ছে। আর বিদ্যমান অংশের প্রশস্তকরণ করা হচ্ছে। এসব রিং রোড মূলত বাইপাস হিসেবে কাজ করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের (সড়ক উইং) সিনিয়র সহকারী প্রধান মোঃ নাজমুল হাসান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা আউটার রিং রোড ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রকল্পের ওপর নির্ভর করেই মূল প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের গাড়ি রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ না করেই যাতায়াত করতে পারবে। রাজধানীতে গাড়ির চাপ সামলাতে এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকার পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর অংশে আউটার রিং রোড নির্মাণ করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, নানা কারণে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সড়ক পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। এতে নগরীতে একটি বিশৃঙ্খল-মিশ্রিত পরিবহন মাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আন্তঃজেলা বাস আউটার রিং রোড অথবা বাইপাসের অভাবে ঢাকা শহরের ভেতরে যাতায়াত করে। ফলে শহরের মধ্যে জটলা তৈরি হয়। এ জন্যই প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমের তুলনায় উত্তর-দক্ষিণে গাড়ির চাপ বেশি। তাই শহরের চারপাশে ইনার রিং রোড ও আউটার রিং রোড নির্মাণ রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশোধিত রুটটি হলো, হেমায়েতপুর-কালাকান্দি-তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু-মদনপুর-ভুলতা (ঢাকা বাইপাস হয়ে)-কড্ডা (গাজীপুর)-বাইপাইল (ঢাকা ইপিজেড)-হেমায়েতপুর।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর ও পূর্বাংশের সংযোগ স্থাপন করবে। সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা থেকে মুন্সীগঞ্জ ও মাওয়া হয়ে যাত্রাবাড়ী দিয়ে অসংখ্য যান ঢাকা শহরে প্রবেশ করবে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অসহনীয় করে তুলতে পারে। তাই সংশোধিত এসটিপিতে প্রস্তাবিত এলাইনমেন্টের মধ্যে রিং রোডের দক্ষিণ অংশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বলা হয়েছে।

সেখানে আরও বলা হয়, এ দক্ষিণ অংশ মানে হেমায়েতপুর-কালিকান্দি-মদনপুর অতিদ্রুত নির্মাণ করা উচিত। এই ৪৮ কিলোমিটার অংশের জন্য তিনটি রুট প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়ককে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করবে।

সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অনেকদিন ধরেই প্রকল্পটি নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরাও মনে করি, প্রকল্পটি চালু হলে ঢাকার ওপর বাইরের যানবাহনের চাপ অনেক কমে আসবে। এতে যানজট কমবে। তিনি বলেন, যানজট নিরসনে এ ধরনের রিং রোড প্রকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ করে দেবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে পারবেন। তেমনি জ্বালানি খরচ কমবে।

Comments (0)
Add Comment