আমরা প্রত্যেকেই ছেলেবেলায় একজন বৃদ্ধ রাজার গল্প শুনেছি, যিনি শত্রুপক্ষের আসার খবর শুনে কোনো রকম বাধা না দিয়েই অন্য জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, আর তার শত্রুপক্ষ বিনা যুদ্ধে তার রাজ্য দখল করে নিয়েছিলো, তাও আবার হাতে গোণা কয়েকজন সৈন্য নিয়ে। মনে আছে তো সেই গল্প? আমাদের গল্পের এই বৃদ্ধ রাজা আর কেউ নন, সেন বংশের অন্যতম প্রধান রাজা লক্ষ্মণ সেন।
এটি তো ছিলো লক্ষ্মণ সেনের পতনের গল্প, কিন্তু তার আগে তো নিঃসন্দেহে সেন রাজবংশ খুব বেশি গুরুত্ব বহন করতো। প্রথমে তাহলে সেন বংশের উত্থানের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
আসলে সেনদের পূর্বপুরুষরা কোনো রাজবংশীয় ছিলো না। অত্যন্ত চতুরতার সাথে একজন সামন্তরাজ পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার সিংহাসন দখল করে বসেন। এই সামন্ত শাসক হলেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেন, যদিও তিনি কোনো ‘রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন নি।
সামন্ত সেন এসেছিলেন বর্ধমান অঞ্চল থেকে। তিনিই সেনদের মধ্যে প্রথম বাংলায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। সেনদের আদি নিবাস ছিলো দক্ষিণের কর্ণাটকের মহীশূর অঞ্চলে। প্রথম জীবনে তিনি কর্ণাটকেই ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে বাংলায় এসে গঙ্গার তীরে রাঢ়ের কোথাও বসতি গড়ে তোলেন। বাংলা তখন পাল রাজাদের অধীনে। পাল রাজারা বিদেশী কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করতেন। এভাবেই সামন্ত সেন পাল রাজাদের মহাসামন্ত হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাল রাজ্য বিভিন্ন কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। আর পাল রাজাদের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করেই সামন্ত সেন গড়ে তোলেন সেন রাজবংশ।
সেন রাজারা প্রায় একশত আটাশ বছর (১০৯৭-১২২৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা শাসন করেন। তারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। এ জন্য সেনযুগে ব্রাহ্মণরা সর্বোচ্চ মর্যাদা পায় এবং হিন্দুরা রাজপৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
সেনরা ছিলো ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’। তারা ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলো এবং ব্রাহ্মণ্য আচারও পালন করতো। কিন্তু একই সাথে তারা রাজ্যশাসন এবং যুদ্ধবিদ্যাও অনুশীলন করতো। এ জন্য সেনদের ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ বলা হয়। তারা যেমন শাস্ত্রবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলো, তেমনি রাজ্যশাসন ও অস্ত্রবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলো।
ধারণা করা হয়, সেনরা দক্ষিণের ওষধিনাথ নামক একজন ব্রাহ্মণের বংশজাত। তাই সেনদেরকে ‘দ্বিজরাজ ওষধিনাথ বংশজ’ বলা হয়।
চন্দ্রবংশীয় বীরসেন ছিলেন সেন রাজাদের আদি পুরুষ। কর্ণাটক অঞ্চলে তখন তার শাসন চলতো। ধারণা করা হয়, তিনি একজন রাজপুত্র ছিলেন। যুদ্ধবিগ্রহে তার বেশ খ্যাতি ছিলো।
সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেনের ছেলেই হলেন সেন বংশের প্রথম মহারাজা হেমন্ত সেন। তিনিই মূলত সেন রাজ্যকে গড়ে তোলেন। পাল রাজা দ্বিতীয় মহিপালের আমলে সামন্ত বিদ্রোহের সুযোগে তিনি রাঢ়দেশে কাশিপুরী নামক একটি ছোট রাজ্য গড়ে তোলেন। তিনি বিয়ে করেন রাণী যশোদেবীকে, যিনি ‘মহারাজ্ঞী’ উপাধির অধিকারিণী ছিলেন।
হেমন্ত সেন তো মাত্র একটি ক্ষুদ্র সেন রাজ্যের নির্মাতা ছিলেন, কিন্তু এই রাজ্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন তার ছেলে বিজয় সেন।
বিজয় সেন হলেন সেন বংশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী রাজা। তার আরেকটি নাম হলো ধী সেন। তিনি ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা সেন রাজ্যকে একটি পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। বিজয় সেনের রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায় সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’ থেকে। ১০৯৭-১১৬০ খ্রিস্টাব্দ ছিলো তার রাজত্বকাল। পাল বংশের শেষ রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেন নি। পূর্ণরূপে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন তিনি। পাল বংশের শেষ রাজা মদন পালকে তার রাজধানী গৌড় থেকে বিজয় সেনই বিতাড়িত করেছিলেন। এতে মদন পাল উত্তর বঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আট বছর পর মদন পালের মৃত্যু হলে বিজয় সেন উত্তর বঙ্গও দখল করে নেন। দক্ষিণে আক্রমণ করেন তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে এবং বর্মনদের রাজধানী বিক্রমপুর নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। এরপর তিনি কামরূপ, কলিঙ্গ ও মিথিলা আক্রমণ করেন। তিনি রামপালকে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন এবং এর বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তিনি নান্য, বীর, রাঘব, বর্ধন প্রভৃতি রাজাদেরও পরাজিত করেছিলেন। পশ্চিমের বিরুদ্ধে তিনি নৌ অভিযান করেন এবং সফল হন।
বিজয় সেন বিয়ে করেছিলেন শূরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবীকে, যেনো শক্তিশালী শূর বংশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। বিলাসদেবী ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য ও গুণবতী নারী। তিনি রাঢ়ের প্রধান মহিষীয় পদের গৌরব ছিলেন।
উড়িষ্যার শাসক অন্তবর্মণের সাথে বিজয় সেনের সামরিক চুক্তি হয়েছিলো। শূরবংশের সাথে সুসম্পর্ক ও উড়িষ্যার অন্তবর্মণের চুক্তি বিজয় সেনের জন্য সেন রাজ্য বিস্তারে অনেক সহায়ক ছিলো।
বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী ছিলো হুগলি জেলার বিজয়পুরে এবং দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপিত হয় বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে।
বিজয় সেনের সভাকবি ছিলেন উমাপতি ধর। রাজশাহীর দেওপাড়া থেকে আবিষ্কৃত দীর্ঘ দেওপাড়া প্রশস্তিটি তিনিই রচনা করেছিলেন।
বিজয় সেনের আমলে চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে একটি বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবের নাম ছিলো ‘স্বর্ণালী তুলাপুরুষ মহাদান উৎসব’। স্বয়ং প্রধান মহিষী মহারাণী শূরবংশীয় বিলাসদেবী এই আয়োজনের দায়িত্বে থাকতেন। উৎসবটির প্রধান পুরোহিত ইদয়করদেব শর্মাকে বিজয় সেন উপহারস্বরূপ স্থায়ীভাবে ভূমি দান করেছিলেন। বিজয় সেন এই উৎসব উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের এতোটাই দান করতেন যে ব্রাহ্মণরা বিত্তশালী হয়ে যেতো।
বিজয় সেন দীর্ঘ ৬২ বছর সেন রাজ্যের শাসক ছিলেন। ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার ছেলে বল্লাল সেন।
বল্লাল সেনের জন্ম হয় ১০৮৩ সালে রামপাল নগরে। তিনি ছিলেন সেন রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান রাজা। বাবা বিজয় সেনের বিশ্বাস অনুযায়ী, তার জন্ম হয় শিবের বরে, তাই তার নাম রাখা হয় ‘বরলাল’। পরবর্তীতে এই নামের অপভ্রংশ রূপ ‘বল্লাল’ তার আসল নাম হয়ে দাঁড়ায়।
বল্লাল সেন একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজকুমার ছিলেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি অস্ত্রবিদ্যা ও শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
বল্লাল সেন ১১৬০ থেকে ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (১৯ বছর) বাংলায় রাজত্ব করেন। তার উপাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘অবিরাজ নিঃশঙ্ক শঙ্কর’। তার রাজ্য পূর্বে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে মগধ ও উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিলো। তিনি মগধ ও মিথিলা অধিকার করেছিলেন এবং বাগড়ি অঞ্চল (সুন্দরবন ও মেদিনীপুর) তার আমলেই সেন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। পাল রাজাদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত বল্লাল সেনই হেনেছিলেন।
দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে সেনদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। কারণ বল্লাল সেন দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকন্যা রমাদেবীকে বিয়ে করেন।
প্রজাদের সৎ পথে পরিচালিত করার জন্য তিনি একটি প্রথা তৈরী করেন। এই প্রথা অনুযায়ী প্রতি ছত্রিশ বছর পর প্রজাদের মধ্যে বাছাই করে দেখা হবে কারা নবগুণবিশিষ্ট (নয়টি গুণসম্পন্ন), আর কারা নবগুণবিশিষ্ট নয়। নবগুণগুলো হলো- আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, শান্তি, তপ ও দান। যারা নবগুণবিশিষ্ট তাদেরকে ‘কুলীন’ এবং বাকিদেরকে ‘অকুলীন’ আখ্যা দেয়া হতো। কুলমর্যাদা পাওয়ার লোভে যেনো প্রজারা ধার্মিক ও গুণবান হওয়ার চেষ্টা করে। এ জন্যই এই প্রথার সৃষ্টি। এই সৃজনশীল প্রথাটির নাম হলো ‘কৌলীন্য প্রথা’।
বল্লাল সেন পাঁচটি বই লিখেছিলেন- ‘দানসাগর’, ‘অদ্ভূতসাগর’, ‘ব্রতসাগর’, ‘আচারসাগর’, ‘প্রতিষ্ঠাসাগর’। এর মধ্যে ‘দানসাগর’ তিনি নিজেই ১১৬৮ খ্রিস্টাব্দে শেষ করেন। কিন্তু ‘অদ্ভূতসাগর’ শেষ করতে হয় তার ছেলে লক্ষ্মণ সেনকে।
তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির, বিক্রমপুরের বল্লালবাড়ি (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ), নির্জরপুর বল্লালবাড়ি (বর্তমান বগুড়া শেরপুর) ও বল্লাল ঢিপি নির্মাণ করেন।
বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় একটি ঢাকা দুর্গাদেবীর বিগ্রহ (যে দেবীমূর্তির চেহারা ও আকৃতি মানুষের মতো হয় না তাকে বিগ্রহ বলে) খুঁজে পাওয়ায় তিনি ঐখানে ঢাকেশ্বরী (ঢাকা ঈশ্বরী) মন্দির স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই ‘ঢাকেশ্বরী’ নাম থেকে ‘ঢাকা’ নামের উৎপত্তি হয়।
বল্লাল সেন জীবনের শেষ সময়টা নির্ভেজাল ও শান্তিপূর্ণভাবে কাটাতে চেয়েছিলেন। তাই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছেলে লক্ষ্মণ সেনকে রাজ্যভার বুঝিয়ে দিয়ে তিনি স্ত্রী রমাদেবীকে নিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরবর্তী একটি জায়গায় চলে যান এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।
এবার জানা যাক আমাদের ছেলেবেলার গল্পের সেই বৃদ্ধ রাজার কথা, যিনি লক্ষ্মণ সেন নামে সুপরিচিত। বোঝাই যাচ্ছে, লক্ষ্মণ সেন ছিলেন সেন বংশের তৃতীয় প্রধান রাজা এবং ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
লক্ষ্মণ সেন ১১৭৯ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (২৭ বছর) সেন রাজ্যের শাসক ছিলেন। আসলে তিনি শাসনভার নিয়েছিলেনই ৬০ বছর বয়সে। এর আগে পিতামহ বিজয় সেন বেঁচে থাকতেই তিনি অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং বীরত্বের সাথে জয়লাভ করেছিলেন। যদিও রাজা হওয়ার পর তাকে গৌড় (মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ) পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিলো। এ কারণেই তাকে ‘গৌড়েশ্বর’ বলা হয়।
লক্ষ্মণ সেন চেদিরাজ, স্লেচ্ছরাজ, সামন্ত বল্লভরাজ এবং গৌড়রাজের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন।
লক্ষ্মণ সেনের পূর্বসূরিরা শিবের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তাই তিনি ‘পরমবৈষ্ণব’ এবং ‘পরমনারসিংহ’ উপাধির অধিকারী ছিলেন। তার সভাকবি ছিলেন উমাপতি ধর, শরণ, ধোয়া, গোবর্ধন এবং জয়দেব।
লক্ষ্মণ সেন ছিলেন একজন সাহিত্যানুরাগী রাজা। বাবা বল্লাল সেনের ‘অদ্ভূতসাগর’ বইটি তিনিই শেষ করেছিলেন।
‘তবকাত-ই-নাসিরী’ এর রচয়িতা মুসলমান ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরিজ লক্ষ্মণ সেনের দানশীলতা ও ঔদার্যের প্রশংসা করে তাকে বাংলার ‘বিখ্যাত রায়’ বলে অভিহিত করেন এবং সুলতান কুতুবউদ্দীনের সাথে তার তুলনা করেন।
লক্ষ্মণ সেনের পতনের ইতিহাস সবচেয়ে বিস্ময়কর। কারণ, যিনি যৌবনে এতো সাহসী ও জয়ী বীর যোদ্ধা ছিলেন, তিনি যে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা না করে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাবেন, তা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।
আসলে লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন এবং তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বিজয় সংঘটনের বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সেন রাজারা ইতিহাসের সবচেয়ে অত্যাচারী রাজা ছিলেন এবং লক্ষ্মণ সেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সেনরা গোঁড়া হিন্দু ছিলো বিধায় অন্য ধর্মের প্রতি তাদের কোনো সহমর্মিতা ছিলো না। অনেকের মতে, বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথা একটি সর্বনাশা প্রথা, যা জঘন্য জাতিভেদের জন্য দায়ী। লক্ষ্মণ সেনের সময় এই প্রথা আরও কঠোর রূপ ধারণ করে। এই কৌলীন্য প্রথার অজুহাতে সেনরা নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর এতো বেশি অত্যাচার করেছে যে, অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তখন নেপালে পালিয়ে যায় এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অন্য ধর্ম ও সুফি-সাধকদের জীবনাচরণ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া শুরু করে। তারা সবসময়ই সেন রাজাদের পতন কামনা করতো। লক্ষ্মণ সেনের সময় প্রজাদের একটি বিদ্রোহও ঘটেছিলো।
তখন বাংলার রাজধানী ছিলো নদীয়া। লক্ষ্মণ সেন অতিবৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজ্য ঠিক মতো পরিচালনা করতে পারছিলেন না এবং উটকো বিশৃঙ্খলাও সামাল দিতে পারছিলেন না। তাই সবচেয়ে সুরক্ষিত নদীয়ায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পন্ডিতগণ তাকে তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজির কথা বলে সতর্ক করে দেয়, যে কিনা একের পর এক হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজ্য দখলে ব্যস্ত ছিলেন। লক্ষ্মণ সেন নদীয়ায় গেলেন ঠিকই, কিন্তু অতিবার্ধক্য ও প্রজাবিদ্রোহ তাকে খলজি সেনার ভয়ে ভীত করে দিলো। তাই তিনি নদীয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করলেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে নদীয়া আসলেন পেছনের ঝাড়খন্ডের শ্বাপদসংকুল বনের মধ্য দিয়ে। এই খবর শুনে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে লক্ষ্মণ সেন বিপরীত পথ দিয়ে নৌ পথে বিক্রমপুর পালিয়ে যান।
প্রজারাই যখন মুসলমান শাসকের আনুগত্য মেনে নিয়েছিলো, তখন অতিবৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনের এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।
অবশ্য বিক্রমপুর গিয়ে তিনি শাসনকাজ চালাতে থাকেন। তার মৃত্যুর পর মাধব সেন নামক তার একজন ছেলে প্রথমে রাজা হয়। এরপর লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম স্ত্রী তন্দ্রাদেবীর গর্ভের সন্তান কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন পর পর রাজা হয়েছিলেন। বিশ্বরূপ সেনের মৃত্যুর পর তার ছেলে সূর্য সেন বাংলার রাজা হয়। ‘পঞ্চরক্ষা’ নামক একটি বৌদ্ধগ্রন্থের পান্ডুলিপি থেকে জানা যায়, সেন বংশের শেষ রাজা ছিলেন মধু সেন।
আসলে লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই সেন বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন থেকে নামমাত্র রাজ্যশাসন চলছিলো। সেন রাজ্যের খুঁটি শক্ত হাতে আর কেউই ধরতে পারে নি। প্রজাবিরোধী শাসন কখনোই বেশি দিন টিকতে পারে না, তাই সেনদের পতন ছিলো অনিবার্য। কিছুদিন পর এই নামমাত্র শাসনেরও অবসান ঘটে এবং শুরু হয় মুসলমান শাসকদের রাজত্ব।
[লেখকঃ চেয়ারপারসন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংরেজি) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা]