আদর্শ কৃষক, আদর্শ ব্যবসায়ী, আদর্শ উদ্যোক্তা। এক কথায় একের মধ্যে একাধিক। বলছি, হুমায়ন আহমেদের কথা। হুমায়ন আহমেদ আদর্শ কৃষক হিসেবে রাজবাড়ী জেলার সেরাদের সেরা। সফল হয়েছেন ব্যবসায়ও। এই হুমায়ন আহমেদের কথা বলতে গেলে পিছনের কথা বলতে হয়।
রাজবাড়ী জেলা গোয়ালন্দ উপজেলা দৌলতদিয়া ইউনিয়নের তোরাপ শেখের পাড়ার আব্দুল হক ও ফরিদা বেগম দম্পতি সন্তান তিনি। জম্মের ৩ মাস আগে বাবা হারিয়েছেন। বুকের দুধ ছাড়তে না ছাড়তে অন্য জায়গায় বিয়ে হয় মায়ের। পাননি বাবা-মায়ের আদর। আশ্রয় হয় মামা গোলাম মোস্তফার কাছে। শিশু বয়সে মামা বাড়ি বড় হয়েছেন। মামা গোলাম মোস্তফা দরিদ্র। যে কারণে ইচ্ছা থাকার পরও একাডেমিক শিক্ষা দিতে পারেননি। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর মামা বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কর্মের খোঁজে স্থানীয় গোয়ালন্দ বাজারে ইলেকট্রনিক (টিভি, ফ্রিজ, ফ্যান) দোকানে মেরামতের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু। চার বছর কাটিয়েছেন সেই দোকানে। কিন্ত সেখানে মন বসেনি। কারণ কাস্টমারের কথা দিয়ে কথা রাখতে পারতেন না। যে কারণে চার বছরের কর্মজীবন শেষ করে ২০০৪ সালে শুরু করেন কৃষি কাজ।
কৃষি কাজে প্রথম বছরেই সাফল্য আসে। অন্যের ৩ বিঘা জমি নিয়ে ধান চাষ করেন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ধান আবাদ করে উৎসাহ বেড়ে যায় হুমায়নের। ২০০৮ সালে করেন বিটি বেগুনের চাষ। পেয়েছেন উচ্চ ফলন। ২ বছরের যেতে না যেতে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনীতিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাধা পেরিয়ে তৎকালীন গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ মন্ডল সারের ডিলারের লাইন্সেস দেন হুমায়নকে। কৃষি কাজের পাশাপাশি শুরু করেন সারের ব্যবসা। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। হুমায়নের ব্যবসা ও কৃষি কাজে সাফল্য আসতে থাকে। গোয়ালন্দ কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে (এসএমই) প্রকল্পের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন শুরু করেন। তারপর বাজারজাত। বীজ উৎপাদনেও সফলতা পায় হুমায়ন। ব্যবসা ও কৃষিতে সফল হলেও হুমায়নের মধ্যে অহংকার নেই। তিনি কৃষকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন।
বর্তমান বীজ উৎপাদন, ডেইরি ফার্ম, হ্যাচারি, সার, জ্বালানি তেল, মবিলসহ একাধিক ব্যবসা রয়েছে হুমায়নের। এখন তার মাসিক বেতনভুক্ত ১৪ জন কর্মচারী রয়েছে। তার ক্ষেতে দিনমজুর হিসেবে প্রতিদিন ৫০/৬০ জন কাজ করেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দুই শত বিঘা জমিতে প্রদর্শনী কৃষি প্রজেক্ট রয়েছে।
হুমায়ন আহমেদ আদর্শ কৃষক হিসেবে রাজবাড়ী জেলার সেরাদের সেরা হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে তুরস্ক, নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ভ্রমণ করেছেন।
বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে দেখেছেন, শিখেছেন অনেক অজানা তথ্য। একাডেমি শিক্ষা না থাকলেও বাস্তবে অনেক কিছু শিখেছেন। অর্থের অভাবে হুমায়ন শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও শিক্ষার প্রতি রয়েছে ঝোঁক। যে কারণে সহযোগিতা করেন অসহায় শিশুদের। অর্থ-অভাবে যে সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন।
হুমায়ন আহমেদ বলেন, ‘ইচ্ছা ও সততার বিকল্প নেই। একটা সময় পেটভরে খেতে পাইনি। ইচ্ছা থাকার পরও এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমার বন্ধুরা যখন স্কুল/কলেজে গেছে, আমি তখন দুই বেলা খাবার জোগাড় করার জন্য অন্যের দোকানে কাজ করেছি। ভালো কাপড় না থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারিনি।’
হুমায়ন আহমেদ বলেন, ‘আমার সফলতার পিছনে সবচেয়ে অবদান গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের। যিনি যখন এসেছেন, আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন। আমি শুধু তাদের দেওয়া পরামর্শ পালন করার চেষ্টা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন রয়েছে— রাজবাড়ী জেলায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো। আমি বিশ্বাস করি, পদ্মা নদীর পাড়ের রাজবাড়ী জেলায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো যাবে।’
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান জানান, হুমায়ন আহমেদ অন্যদের আইডল। তার সফলতার পিছনে রয়েছে সততা এবং সঠিক লক্ষ্য। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে তিনি কৃষি চাষ করেন। যে কারণে তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছেন। অন্য কৃষকদের অনুরোধ তাকে অনুসরণ করতে।