খেজুর গুড়ে চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি

অনলােইনে রস বিক্রি, কমেছে গুড়ের উৎপাদন

মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে ঘোরে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। রাজশাহীতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব আছে খেজুরের নস দিয়ে তৈরি গুড়ের। তবে এবার গাছ থেকে সংগৃহীত রস গুড় হওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। এতে কমেছে গুড়ের উৎপাদন; বাড়ছে দাম।

গাছি ও গুড়ের কারিগররা বলছেন, এ বছর অনলাইনে খেঁজুরের রসের বিক্রি বাড়ায় কমছে গুড়ের উৎপাদন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলার চার উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। চলতি মৌসুমে যা থেকে এ বছর প্রায় নয় হাজার টন খেজুরের গুড় উৎপাদনের আশা কৃষি বিভাগের।

সূত্র জানিয়েছে, দেশজুড়ে রাজশাহীর আমের যেমন খ্যাতি, তেমনই খেজুর গুড়ের। জেলার গাছিরা শীতের মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পরে প্রক্রিয়াজাত করে এ গুড় তৈরি করেন। উৎপাদিত গুড় কেনাবেচা হয় উপজেলার হাটগুলোতে। সেখান থেকে কিনে পাইকাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে। এ গুড় বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদুও। জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে স্থানীয় এ পণ্যটি।

রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় প্রচুর খেজুর বাগান রয়েছে। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনাতেও রয়েছে খেজুর গাছ। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০টি খেজুর গাছের রস আহরণ করে। বিকেলে গাছে কোর (মাটির তৈরি হাড়ি) লাগিয়ে আসেন। আর সকালে রসভর্তি কোর নামান গাছিরা। খেজুরের রস ও গুড় তৈরিকে কেন্দ্রে করে বছরের আড়াই থেকে তিন মাস ব্যস্ত থাকেন তারা।

কাটাখালীর হারিয়ান গ্রামের গাছি শমসের আলী। তিনি ২৬ থেকে ৩০ বছর ধরে খেজুরের গাছ লাগান। রস সংগ্রহ ছাড়াও তৈরি করেন গুড়ও। বেশির ভাগ গাছ নিজের এলাকাতেই। তবে ১৫ থেকে ২০টি আছে রাজশাহী চিনি কলের ইক্ষু ফার্মে।

শমসের আলী জানান, কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো অন্যের গাছ। আমার খেজুরের গুড় খাঁটি। তবে, কিনতে হলে এক সপ্তাহ আগে জানাতে হবে। প্রায় ১২০টি গাছের রস সংগ্রহ করি। সেগুলো বাড়িতে জ্বাল করার পর প্রায় ২২ থেকে ২৫ কেজি গুড় পাই। জ্বালানি ও অন্য কিছু খরচ বাদ দিয়েও ভালো লাভ হয়।

এদিকে রাজশাহীর গুড় অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে দেদার। কিছু শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা সরাসরি চুক্তিতে গাছ কিনে গাছিদের মাধ্যমেই গুড় তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করছেন।

রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমি চারঘাট ও দুর্গাপুরে বেশ কিছু খেজুর গাছ কিনেছি। নিজস্ব গাছির মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে নিজেদের তত্ত্বাবধানেই নির্ভেজাল খেজুর গুড় গ্রাহকের হাতে তুলে দিচ্ছি। যেহেতু একেবারেই খাঁটি তাই দামটা একটু বেশিই রাখতে হচ্ছে।’

একজন গাছি বলেন, ‘৭০ থেকে ৮০টি গাছ লাগাই। এতে আমার গুড় হয় ২০ থেকে ২৫ কেজি।’

সংগৃহীত রস আগুনের তাপে পরিবর্তন হয় গাঢ় গুড়ে। জ্বালানি, জ্বালের মাত্রা আর নানান রকম পরীক্ষায় স্বাদ নির্ধারণ করেন গুড়ের কারিগর। ক্রেতার চাহিদা অনুসারে গুড়কে পাটালি, খুরি বা আধুনিক ফয়েল পেপারের আকার দেওয়া হয়। মান ভেদে হয় দামের পার্থক্য।

একজন গুড়ের কারিগর বলেন, ‘গত দুই হাট হলে গুড়ের চাহিদা বেড়েছে, দামও বেড়েছে। আবার শীত পড়তে রসটাও বেড়ে গেছে। অনলাইনেও গুড়ের দাম ৩০০ টাকা করে বিক্রে করছি আমরা। আর বাজারে বিক্রি করছি ২০০ থেকে ২২০ টাকা করে।’

সপ্তাহ জুড়ে জেলার চার উপজেলার শত-শত গ্রামে উৎপাদিত গুড় সংগ্রহ করে কৃষক। সপ্তাহের দুই দিন বানেশ্বর ও ঝলমলিয়া হাটে বিক্রি হয় গুড়। এক হাটে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার গুড়ের বেচাকেনা হয় এখানে।

একজন বিক্রেতা বলেন, ‘বাজার যাচ্ছে ১৮০, ১৯০ বা সর্বোচ্চ ২০০ টাকা করে। গুড়ের মান এবার খুবই ভালো।’

শুধু হাটেই নয়, অনলাইনের সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই কিনছেন গুড়। মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যের বালাই না থাকায় গুনে মানে পাচ্ছেন সেরা পণ্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘অনলাইনে এই ব্যবসাগুলো যখন বাড়বে, বিটুবি বাড়বে বা অনলাইনে সরাসরি উৎপাদনকারীর থেকে ক্রেতা নিতে পারবে, এটা সম্ভব করা। তখন কিন্তু লাভবান সবচেয়ে বেশি হবে উৎপাদনকারীরা।’

Comments (0)
Add Comment