বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহী পেশাদারদের নিয়ে গঠিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম, অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) ভ্যাকসিন (যা করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে আমদানি ও বিতরণ করা হবে) ঘিরে যেসব ঘটনার খবর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে সেসব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে ফোরাম জানায়- বৈশ্বিক মহামারী করোনায় ইতিমধ্যেই লাখ লাখ লোকের প্রাণ গেছে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। তদুপরি, এর দ্বারা প্রতি মাসে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৩৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়ে চলেছে।
ভ্যাকসিনের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির (যেমন- মুখে মাস্ক ব্যবহার, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা) কঠোর প্রয়োগ মহামারী নিয়ন্ত্রণ, জীবনের মর্মান্তিক ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং অর্থনীতিকে ঠিক জায়গায় আনতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির উপর করোনার বিরূপ প্রভাব কমাবার করার একমাত্র উপায় ভ্যাকসিনে বিশ্বব্যাপী সবার ন্যায্য অধিকার (বিশেষত স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের সুরক্ষা) নিশ্চিত করা।
কোভিড-১৯ পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনগুলোর উন্নয়ন, উৎপাদন এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার ত্বরান্বিত করার জন্য একাধিক উন্নয়ন অংশীদারদের দ্বারা অ্যাক্সেস টু কোভিড -১৯ (এসিটি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) দ্বারা সমন্বয় করা হয়েছে। কোভাক্স এসিটির অন্যতম স্তম্ভ এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন (জিএভিআই), কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপারেডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) এবং ডব্লুএইচও এর তদারকিতে রয়েছে।
করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বানানো তখন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কোভাক্স এর লক্ষ্য ছিল করোনার ভ্যাকসিন বানানো ও উৎপাদন ত্বরান্বিত করা এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য ন্যায্যমূল্য এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকারের গ্যারান্টি দেওয়া।কোভ্যাক্স এর গবেষণা উন্নয়ন উৎপাদন বিনিয়োগ কমিটি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি গ্রুপ। এই গ্রুপে রয়েছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা যারা কোভ্যাক্স এর অর্থায়নে পরিচালিত সম্ভাব্য ভ্যাকসিন প্রকল্পগুলোতে ভ্যাকসিন উন্নয়ন এবং উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন।
ইনোভিও, মডার্না, কিউরভ্যাক, নোভাভ্যাক্স, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়, থেমিস/ইনস্টিটিউট পাস্তুর/পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (মার্ক), ক্লোভার বায়োফার্ম্যাটিকালস এবং অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) সহ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন প্রকল্প কোভাক্সের আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছে যা তাদেরকে রেকর্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনগুলোর দ্রুত বিকাশে সক্ষম করে তুলে।
অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) তাদের করোনা ভ্যাকসিন বিকাশের জন্য কোভ্যাক্স থেকে ‘জনস্বার্থে’ ৩৮৪.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছিল। এই সাহায্য দুই ভাগে মঞ্জুর করা হয়: ২০২০ সালের মার্চে প্রাথমিক অনুদান যা প্রি ক্লিনিক্যাল এবং প্রথম ধাপের পরীক্ষায় (১.১ মিলিয়ন ডলার) সাহায্য করতে এবং ২০২০ সালের জুনে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানান্তরে সাহায্য করতে (৩৮৩ মিলিয়ন ডলার)। এই অনুদান কঠোর শর্তে দেয়া হয়েছিল যে অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) এবং এর উৎপাদনকারী অংশীদারদের অবশ্যই মহামারী চলাকালীন সময়ে অলাভজনক ভিত্তিতে ভ্যাকসিনগুলো বিক্রি করতে রাজি থাকতে হবে এবং তদনুসারে, অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় যে এই ভ্যাকসিনটি মহামারীকালীন সময়ে অলাভজনক ভিত্তিতেই বিক্রি করা হবে।
অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর্জেন্টিনা, চীন, ভারত, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়ার বেশ কয়েকটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি স্থানান্তর করেছিল। সেরাম ইনস্টিটিউট হল সেই চুক্তির অধীন ভারতের একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোভ্যাক্স এর সহায়তা পাওয়া অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) এর প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার এই চুক্তি উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনও পক্ষ নয়।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (“বেক্সিমকো ফার্মা”), বাংলাদেশে নিবন্ধিত একটি বেসরকারী ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যা বাংলাদেশে অক্সফোর্ড (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) ভ্যাকসিনের একমাত্র পরিবেশক হয়ে ওঠে।তারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়/অ্যাস্ট্রাজেনেকা সার্স-কোভ -২ ভ্যাকসিনের ৩০ মিলিয়ন ডোজের একমাত্র উৎস সরবরাহকারী এবং পরিবেশনকারীরূপে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্থান করে নেয় যেখানে বাংলাদেশ সরকার ছিল ‘কো-সিগনি’।
এটি কোভ্যাক্স দ্বারা প্রকাশ্যে প্রকাশিত পূর্বের বক্তব্যের বিপরীত যে তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন সুবিধা থেকে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে যে কোন ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা ‘গ্লোবাল পাবলিক গুড’ হিসেবে গণ্য হবে এবং একেবারে বাণিজ্যিকীকরণ করা হবে না।
করোনায় তীব্রভাবে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেরও করোনার ভ্যাকসিনের খুব প্রয়োজন। যেহেতু কোভ্যাক্স বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার সবার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ২০ শতাংশ সরবরাহ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, বাংলাদেশ সরকারকে তার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন দেয়া নিশ্চিত করতে দ্বিপাক্ষিকভাবে অন্যান্য বিকল্পগুলোর সন্ধান করতে হবে।
তবে সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে বেক্সিমকো ফার্মার একমাত্র পরিবেশক হয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে সমঝোতা স্মারকে অংশ নেয়া বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রথমত, এটি কি পূর্বের ঘোষণার লংঘন নয় যেখানে বলে হয়েছিল অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সহ কোভ্যাক্স এর গবেষণা উন্নয়ন উৎপাদন বিনিয়োগ কমিটির সহায়তায় বিকশিত ও উৎপাদিত সমস্ত ভ্যাকসিনগুলো গ্লোবাল পাবলিক গুড এবং সব দেশ অলাভজনক ভিত্তিতে সেগুলোর অধিকার লাভ করবে?
দ্বিতীয়ত, কোভ্যাক্স এর লক্ষ্য ন্যূনতম খরচে ভ্যাকসিনের ন্যায়সঙ্গত বিতরণ নিশ্চিত করা। তাহলে বেক্সিমকো ফার্মাকে বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও বিতরণের একচেটিয়া অধিকার দেয়াটা সেরাম ইনস্টিটিউটের পক্ষে কতোটা নৈতিক?
তৃতীয় এবং সর্বাগ্রে, সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিনের একটি ডোজ স্থানীয়ভাবে ২ মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হবে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ডোজ প্রায় ৫ ডলারে কিভাবে বিক্রি করা হবে? বিশ্বব্যাপী মহামারী চলাকালে এই দামের বৈষম্য কতোটা নৈতিক?
বাংলাদেশে পিপিই, টেস্টিং, স্ক্রিনিং এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ, সরঞ্জাম সংগ্রহ ও বিতরণে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। যে দেশে প্রায় ৭৪ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষকে নিজেদের পকেট থেকে পরিশোধ করতে হয়, এসব দুর্নীতির প্রতিটি ক্ষেত্রই ইতিমধ্যে আর্থিক দুর্ভোগে জর্জরিত সাধারণ মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে এবং সবমিলিয়ে এগুলো লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষকে আঘাত করে যারা সব ধরণের বিপর্যয়ের ধাক্কা কাঁধে নেয়। করোনা আসার পর স্পষ্টতই দেশটি সেই একই পথে এগিয়ে চলেছে যে পথ অনিশ্চয়তা, বৈষম্য, বঞ্চনা এবং ভোগান্তির।
করোনা ভ্যাকসিনের রফতানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ভারতের সর্বশেষ ঘোষণার পর সেই অনিশ্চয়তার মাত্রা আরও উপরে উঠেছে যদিও ৫ জানুয়ারি এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব আশ্বাস অনুযায়ী বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।