বাংলাদেশের ‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা’ উন্মাদনা: ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট

বিশ্বকাপ এলেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষ। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমকে নিয়ে বাংলাদেশে যে উন্মাদনা দেখা যায় তা বিশ্বে বিরল। বিষয়টি চোখ এড়ায়নি বিদেশী গণমাধ্যমগুলোরও। মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট শুক্রবার এ নিয়ে একটি বড় একটি প্রতিবেদন করেছে। এতে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল উন্মাদনার ইতিহাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মারামারি পর্যন্ত উঠে এসেছে।

ওই রিপোর্টে সবথেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এদেশের মানুষের পছন্দের দলের পতাকা টানানোর দিকটি। বিশ্বকাপ এলেই কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা টানায় তার বর্ণনা রয়েছে সেখানে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা এমনকি সেতুতেও এই দুই দেশের পতাকা আঁকা হয়েছে। বাংলাদেশিরা বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা নিয়ে তর্কে মেতে থাকে। কখনও কখনও সেটি পাথর ছোড়াছুঁড়িতেও রূপ নেয় বলে লিখেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে এত সব ঘটনা ঘটছে এমন একটি দেশে, যার রাজধানী রিও ডি জেনিরো থেকে সাড়ে নয় হাজার মাইল ও বুয়েন্স আয়ার্স থেকে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মাইল দূরে। এমন একটি দেশে ফুটবল নিয়ে এই উত্তেজনা, যেটিকে ক্রিকেটপাগল দেশ বলে মনে করা হয়।এমনকি এদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই তার জীবনে কোনো আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলীয়র সঙ্গে দেখা হয়নি।

ঢাকায় বসবাসকারী আকেদ কাদের চৌধুরী নামে এক ব্রাজিল-ভক্তের মতে, এটি উন্মাদনা! আপনি যদি সত্যিই একে এক কথায় বলতে চান, তবে এটি এমন এক উন্মাদনা, যা গোটা দেশকে জাগিয়ে তোলে।

নোফেল ওয়াহিদ নামে এক আর্জেন্টিনা-ভক্ত বলেন, জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বড় দেশ। কিন্তু আপনি আর্জেন্টিনা-ভক্ত ও ব্রাজিল-ভক্তদের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারেন। তিনি বলেন, এটি একটি মজার বিষয়, তাই না? এটি কোনো যুক্তিই মানে না। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এত দূরে এশিয়ার মাঝামাঝি এই দেশটিতে ফুটবল নিয়ে এমন প্রতিদ্বন্দিতা কেন? এটি ব্যাখ্যা করা কঠিন।

ওই রিপোর্টে বলা হয়, আশির দশকেই যে এই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয় একমত সবাই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এরপর এক দশক লেগে যায় সেই ধাক্কা সামলাতে। মানুষ যখন রঙিন টেলিভিশন কিনতে শুরু করে তখনই তারা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার রঙ বেরঙের জার্সি পড়া খেলোয়াড়দের দেখতে শুরু করে। আর সেসময়ই মানুষ এই দুই দলের ভক্ত হতে শুরু করে। তবে এ ক্ষেত্রে ডিয়েগো ম্যারাডোনার কথা আলাদা করে না বললেই নয়। ওয়াহিদ বললেন, ম্যারাডোনা ছিলেন মন্ত্রমুগ্ধকর।

ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ এত ভালোবাসলেও বাংলাদেশের ফুটবল উন্নতি করতে পারেনি। ক্রিকেটে যেখানে বাংলাদেশ ওয়ানডে র্যাং কিং-এ ৭ম স্থানে, সেখানে ফিফা র্যাং কিং-এ বাংলাদেশ ১৯২তম অবস্থানে। তবে বিশ্বকাপের সময় এসব ভুলে বাংলাদেশিরা তাদের পছন্দের দুই দলকে সমর্থনে মেতে ওঠেন। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের কথা আজন্ম মনে রাখবে সেই প্রজন্ম। কীভাবে এক জায়গায় জড়ো হয়ে অনেক মানুষ মিলে খেলা দেখতো সেটি এখন ইতিহাস।

ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল রাউন্ড অব ১৬-তে মুখোমুখি হয়েছিল। সেই খেলা দেখতে তখন বাড়িতে বাড়িতে বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। ব্রাজিল ভক্ত কাদের চৌধুরীর বয়স ছিল তখন ১০ বছর। তিনি জানালেন, সে সময় বড় ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল তাদের বাড়িতে। সেখানে তার বাবার বন্ধু ও সহকর্মীরা একত্র হয়েছিলেন। অন্তত ৫০ জন একসাথে বসে সেই খেলা দেখেছিলেন। তিনি বলেন, আমার পরিবার এই হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা দুটি দলের জন্য কেনো কাঁদছে, হাসছে, লাফালাফি করছে তা আমি তখন বুঝতে পারতাম না।

সেই উন্মাদনা এখনও রয়ে গেছে। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দলের নেইমার ও মেসিকে ছাড়া অন্য খেলোয়াড়দের চিনেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা খুব বেশি না। কিন্তু তাতে দলের প্রতি তাদের ভালোবাসার শেষ নেই। ২০২১ সালের জুলাই মাসে দুই দল যখন কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠলো তখন বেশিরভাগ বাংলাদেশি সেই ম্যাচ দেখেছে। কোন টুর্নামেন্ট চলছে বা এর নাম কি তা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে দেখা যায় না তাদের। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার খেলা হচ্ছে এটাই যথেষ্ট।

যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ সেই ম্যাচ বড় স্ক্রিনে দেখতে পারেনি। কারণ ব্রাজিলের সেমিফাইনালের সময় এক সংঘাতের কারণে পুলিশ প্রকাশ্যে জড়ো হয়ে খেলা দেখতে বাধা দিয়েছিল। এমন উন্মাদনার ঘটনা ওটাই প্রথম ছিল না। ২০১৪ সালে বরিশালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সংঘর্ষে ১১ জন আহত হয়েছিলেন। সেখানে এক ব্রাজিল ভক্ত ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোল দেয়ার কথা তুললে ওই সংঘাত শুরু হয়।

২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ব্রাজিল সাত গোল খাওয়ার পর ব্রাজিল-ভক্তদের ‘সেভেন আপ’ বলে ক্ষেপানোর প্রবণতার কথাও উঠে এসেছে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে। আর্জেন্টিনা ফ্যানরা তখন দোকানে গিয়ে সেভেন আপ কেনা শুরু করে এবং ব্রাজিল ফ্যানদের সামনে দাঁড়িয়ে তা খেয়ে তাদেরকে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করে। আর্জেন্টিনা ভক্ত ওয়াহিদও জানালেন, তিনিও এমন কাজ করেছেন।

রাত পোহালেই পর্দা উঠছে ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসরের। এ নিয়ে বরাবরের মতো উন্মাদনায় মেতেছেন বাংলাদেশিরাও। আবারও এদেশের ফুটবলপ্রেমীরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এখানে বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়ছে, সেতু রঙ করে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা টানানো হচ্ছে। চায়ের দোকানে বসলেই শোনা যাচ্ছে ফুটবলের আলাপ। এতদিন পড়ে এসে অনেক বাংলাদেশিই যে এখন জার্মানি সমর্থন করছেন তাও উঠে এসেছে ওয়াশিংটন পোস্টের ওই রিপোর্টে।

Comments (0)
Add Comment