দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ৮৮’র বন্যায় যা ঘটেছিল

১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের প্রলংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটিকে বলা হয়ে থাকে এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক এবং ক্ষয়-ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বের প্রায় সব প্রভশালী গণমাধ্যমে সে সময় এই খবর প্রচার করা হয়।

আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংঘটিত সেই বন্যায় এ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চল ডুবে যায় এবং স্থানভেদে বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

সে বছর সারা দেশে হওয়া প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্টি হওয়া বন্যায় মাত্র তিন দিনে দেশের প্রধান তিন নদীতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়। তাতে দেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলি জমি ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কলেরা, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছিল। গঙ্গা বা পদ্মার পানি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে মেঘনা নদীর ভৈরব বাজার পয়েন্টে পানির উচ্চতা বিপদসীমার ১৮১ সেন্টিমিটার উপরে ছিল।

বন্যার গ্রাসে সরকারি হিসাব অনুযায়ী লোক মারা যায় ৩৩৩ জন। আর বেসরাকরি হিসাবে এ সংখ্যা ৬০০ জনেরও বেশি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ২ কোটি ১০ লাখ, বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৩ কোটি। অন্যদিকে বাস্তুহারা হয় ৩০ লাখ মানুষ।

বন্যায় রাজধানীরও অনেক এলাকা ডুবে যায়। ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, গুলিস্তান, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব এলাকাই জলমগ্ন হয়েছিল। ৬০ লাখ লোকের ঢাকা শহরের প্রায় ৫০ লাখই পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
ঢাকায় প্রায় ৪০০ ত্রাণ শিবির খোলা হয় যেখানে প্রায় ৫ লাখ বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছিল।

বন্যার পানি রানওয়েতে উঠে যাওয়ায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। আবহাওয়া অফিস, আগারগাঁও সমপ্রচার ভবন, পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানেও পানি উঠে গিয়েছিল।

পঙ্গু হাসপাতালে রোগী ভর্তিই বন্ধ রাখা হয়েছিল। পুরনো ঢাকার মিডফোর্ট হাসপাতালে সব অপারেশন স্থগিত রাখা হয়েছিল। শ্যামলী এলাকায় আবাসিক ভবনের একতলা পর্যন্ত তলিয়ে গিয়েছিল পানির গ্রাসে।

ডুবে যাওয়া ঢাকা শহরে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছিল। কারণ ওয়াসার ২৭টি গভীর নলকূপ বিকল হয়ে পড়েছিল। এতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ২০ থেকে ২৫ ভাগ কমে গিয়েছিল।

বন্যাকবলিত ঘিঞ্জি এলাকাগুলোর পরিবেশ শীতল হয়ে উঠেছিল। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছিল ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ নানা ব্যামো। এতে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল।

দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৭টিতে বন্যায় প্লাবিত এবং ৪৬৮টি উপজেলার মধ্যে ২৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিগত ৩৫ বছরে বন্যা কবলিত হয়নি এমনসব উঁচু এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল ৮৮-এর বন্যার সময়।

বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বন্যায় প্রায় ১ কোটি কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ২০ লাখ একর জমির ফসল পুরোপুরি এবং ১৫ লাখ একর জমির ফসল আংশিকভাবে ভেসে যায়। ৮৮ এর বন্যায় সরকারি হিসাবে ক্ষতি হয় ২০ লাখ টন শস্য।

প্রলয়ঙ্করী বন্যায় দেশের ৬ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১ হাজার ১৭৫ কিলোমিটার নষ্ট হয়। তাছাড়া সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। দেশের ২৪৬টি সেতু ও কালভার্ট বিধ্বস্ত হয় এবং প্রায় আড়াই হাজার ফুট রেলপথ বন্যায় ভেসে যায়।

প্রচুর গাছপালা ভেসে যায় এবং পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়। এ ছাড়া হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল। বন্যায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সমগ্র দেশের প্রায় সব যোগাযোগ বিচ্ছেন্ন হয়ে পড়েছিল।

সরকারি সূত্রমতে, ৮৮ এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামতের জন্য তখন প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। বন্যায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।

Comments (0)
Add Comment