চিকিৎসাবিজ্ঞানে মহানবী (সা.)

আবু আল কাসেম মো. ফেরদাউস

মরুর লু হাওয়া, তপ্ত বালি, পাথুরে পাহাড়-পর্বত, মেঘহীন, বৃষ্টিহীন, সবুজের সমারোহহীন শুষ্ক ও রুক্ষ পরিবেশে আজ থেকে প্রায় পনেরশ বছর আগে খোদার হাবিব মানবের জান্নাতের কাণ্ডারি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) জন্মগ্রহণ করেন মক্কা নগরীতে। তখন ছিল অন্ধকার যুগ বা জাহেলিয়াতের যুগ। অত্যাচার-অনাচার, ব্যভিচার, হানা-হানি, মারা-মারি, নাস্তিকতা, পাশবিকতা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্রীতদাস প্রথা, নারী নির্যাতন, অবৈধ রক্তপাত, মাদকের ব্যাপক ছড়াছড়ি সমাজ জীবনে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। মায়া-মমতা, ভালোবাসা, করুণা, প্রেমপ্রীতি, সহনশীলতা ছিল অনুপস্থিত। সেখানে খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও অগ্নিপূজা, মুর্তিপূজা ও অন্যান্য পূজা-অর্চনা বিদ্যমান ছিল। ধর্মের নামে অনেক অধর্মের কাজও নির্দ্বিধায় চলত।

এমনি এক দুর্বিষহ পরিবেশে ৫৭০ খ্রি. ১২ রবিউল আওয়াল কোরাইশ বংশে জন্ম নেন এক মানব শিশু। তখন কী কেউ জানত এ শিশুই হবে আরব জাহানের শাসক, ইসলাম ধর্মের প্রচারক, একজন ন্যায়বিচারক, শান্তির অগ্রদূত, দক্ষ সমর নায়ক, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক, সমাজ সংস্কারক, দয়ার সাগর, নির্মল চরিত্রের অধিকারী, মিষ্টি ভাষী, সংযমী, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল ইত্যাদি মহতী গুণের অধিকারী পরম করুণাময়ের প্রিয়তম বন্ধু।

স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে নবিজি (সা.) যে যুগান্তকারী উপদেশ রেখে গেছেন তা সত্যি বিস্ময়কর। রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সতর্কতা, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণে সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপকারিতা ইত্যাদি বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও অস্বীকার করতে পারেনি। নিচে তার কটি উদ্ধৃতি লিপিবদ্ধ করা হলো-

মহানবি (সা.) উপদেশ দিয়েছেন, কোথাও মহামারি বা কোনো সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে বের না হতে এবং সে স্থানে অনুপ্রবেশ না করতে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে করোনাভাইরাস থেকে জনগণকে সুরক্ষার জন্য ‘লকডাউন’ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় কি?

মুসলমানদের ওজুর মাধ্যমে শরীরকে পাক-পবিত্র করে ইবাদত-বন্দেগি করতে হয়। ওজুর শুরুতে প্রথমে হাত উত্তমরূপে ধৌত করতে হয়। তারপর মুখ বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। হাতের মাধ্যমে যে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে, তাই হাতকে উত্তম রূপে ধৌত করার জন্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপদেশ কী ওজুর হাত ধোয়া সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ? তা ছাড়া প্রতিদিন পাঁচওয়াক্ত নামাজে যে পরিমাণে শরীর নাড়াচাড়া হয়, তা স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর নয় কী?

প্রস্রাব-পায়খানা থেকে রোগ-জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। তাই এ ব্যাপারে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। মুসলমানরা পায়খানা ও প্রস্রাবের পর ইসলামের প্রাকযুগ থেকে যে ঢিলা-কুলুফ ব্যবহার হয়ে আসছে, তা বর্তমানে ওয়াশরুম বা শৌচাগারের টয়লেট পেপার ব্যবহার তার নতুন সংস্করণ নয় কী?

নির্দিষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত যৌনাচার ইসলামে স্বীকৃত। অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ যৌনাচার, বহুগামিতা ইসলাম সমর্থন করে না। সিফিলিস, গনোরিয়া ও এইডস্ ইত্যাদি ব্যাধি অবাধ যৌনচারের ফসল নয় কি?

স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত খাদ্য নয়, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। হালাল-হারাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য নয় কি?

মুখের ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধে আধুনিক দাঁত ব্রাশ বা মাউথ ওয়াশের সঙ্গে ইসলামের প্রাকযুগ থেকে ব্যবহৃত মেসওয়াক কি অসংগতিপূর্ণ?

নেশা বা মাদক মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। নেশা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই ইসলাম বহু পূর্বে এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। মাদকের ভয়াবহতা নিরসনে আধুনিক রাষ্ট্রের ভূমিকা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় কী?

মধু ও কালিজিরার অনন্য গুণাগুণ ও উপকারিতা এবং রোগ ব্যাধি নিরাময়ে এটি যে এক কার্যকরী মহৌষধ তা আজ সর্বজনবিদিত। এ সম্পর্কে নবিজি (সা.)-এর মূল্যবান উপদেশ ও পরামর্শ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান কী অস্বীকার করতে পারছে?

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। শিশুদের সুস্থ ও সবলভাবে গড়ে তুলতে হলে মায়ের দুধের বিকল্প নেই। আজ থেকে প্রায় পনেরশ বছর আগে ইসলাম শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মায়ের দুধের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় বর্ণিত আছে-‘মায়েরা তাদের শিশুদের পূর্ণ দুবছর দুগ্ধ পান করাবে’। মায়ের দুধের উপকারিতা, বিকল্প দুধের অপকারিতা এবং পূর্ণ দুবছর দুগ্ধ পান করানো ইত্যাদি সম্পর্কে নবিজি (সা.)-এর উপদেশ ও পরামর্শ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান কী অস্বীকার করতে পারবে?

৬৩২ খ্রি. ৮ জুন (১২ রবিউল আউয়াল) আমাদের প্রিয় নবি চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরম করুণাময়ের অপার সান্নিধ্যে। আজ তিনি নেই, আছে তাঁর জীবনাদর্শ ও কর্ম। এক অবাক বিস্ময়। মাত্র ৬৩ বছরের একটি ছোট্ট জীবন। ৪০ বছর পর নবুয়ত প্রাপ্তি। ২৩ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন। যে এতিম শিশু জীবনের শুরুতে মেষ পালক। তারপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আরব জাহানের রাষ্ট্রনায়ক। এ স্বল্প পরিসরে ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, সত্যের আলোকবর্তিকা এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালের পথপ্রদর্শক। সমগ্র আরব জাহানের অধিপতি হয়েও তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। ধুলায় বসে শাসনকার্য পরিচালনা এবং আদেশ-নির্দেশ জারি করতেন। তাঁর রাজদরবার ছিল মদিনা মসজিদের সম্মুখে উন্মুক্ত প্রান্তর।

লেখক : সাবেক উপাধ্যক্ষ, চৌমুহনী সরকারি এসএ কলেজ

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.