সাম্য ও সম্প্রীতির বিশ্বনবি (সা.)

জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশাকালে মানবতা বিনাশি দানবের বর্বরতায় আরব ভূখণ্ডসহ তৎকালীন পুরো জগৎ যখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন মানবতাকে রক্ষার জন্য, মানুষের মাঝে প্রীতিবন্ধন গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়, বিবদমান সম্প্রদায়গুলোর মাঝে সখ্য ও সম্প্রীতিভাব গড়ে তোলার জন্য জগতের মানুষকে একত্ববাদ তথা সিরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখানোর জন্যই মুহাম্মাদ (সা.)-এর শুভাগমন হয়।

তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন মানবপ্রেমী, প্রীতি ও সম্প্রীতির সেরা আদর্শ মহামানব। বিশ্বনবি মুহাম্মাদ (সা.) শৈশবের গণ্ডিতে সর্বসাধারণের কাছে ‘আল-আমিন’ পরিচয়ে পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার পরম আস্থাভাজন। তৎকালীন কোনো রাজা বাদশাহ, প্রভাব প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গও জনতার হৃদয়ের আঙ্গিনায় ন্যূনতম বিশ্বাসের স্থানে পৌঁছতে পারেনি।

সে সময়কার মানুষের মনে থাকত এক ধরনের ভীতি, অবিশ্বাসের ডালপালা, যা পুরো সমাজে ছেয়ে যাওয়ার কারণে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। যে হৃদয়ে অবিশ্বাসের ভীতি থাকে সে হৃদয়ে কখনো প্রীতি কাজ করে না। বিশ্বনবি (সা.)-এর বিশ্বস্ততা ও পরম আস্থার নীতি জনগণকে তার প্রীতিতে আবদ্ধ করে, যদ্দরুন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ তার পরম গুণমুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলে ডাকে। পবিত্র কুরআন মাজিদে তার এ চরিত্র মাধুর্য ‘খুলুকে আযীম’ হিসাবে চিত্রিত হয়েছে।

আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা ক্বালাম : আয়াত : ৪)। বিশ্বনবি (সা.) নিজেই তার চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য।’ (কানযুল উম্মাল)।

মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল নবি (সা.)-এর অভ্যাস। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন কখনো ঘৃণা করতেন না, মানুষকে কাছে টানতেন কখনো দূরে সরিয়ে দিতেন না, মজলুম হয়েও প্রতিশোধ নিতেন না বরং ক্ষমা করে দিতেন। তার মানবপ্রীতির এ চিত্রটি তার বক্তব্য ও কর্মে ফুটে ওঠে।

উক্ববাহ বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার সঙ্গে যে আত্মীয়তা ছিন্ন করেছে, তুমি তার সঙ্গে তা বজায় রাখ, তোমাকে যে বঞ্চিত করেছে, তুমি তাকে প্রদান কর এবং যে তোমার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। (আহমাদ : ১৭৪৫২)। মানবতাবোধের উত্তম উদহারণ রাসূল (সা.)-এর জীবনে এভাবে দেখা যায়, এক বুড়ি না বুঝেই ইসলামের বিরোধিতা করত এবং নবি করিম (সা.)কে কষ্ট দেওয়ার জন্য মসজিদে যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত।

একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হলো কিনা এই ভেবে দয়ার নবি (সা.) বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। তিনি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিচয় পেয়ে বুড়ি হতবাক হয়ে গেল। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।

বিশ্বনবি (সা.)-এর মানুষের প্রতি, অসহায়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার রূপটি ইতিহাসের সোনালি পাতায় বিবৃত হয়েছে এভাবে-ঈদের দিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি শিশু কাঁদছে। রাসূল (সা.) সে পথে যাওয়ার সময় শিশুটিকে এ অবস্থায় দেখে আবেগমাখা সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে?’ শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা নেই। ঈদের দিনে নতুন কাপড় আমার নেই। আমার সাথিরা নতুন কাপড় পরে খেলাধুলা করছে।’ দয়ার নবি শিশুটিকে নতুন কাপড় কিনে দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)কে বললেন, তোমার জন্য একটি ভাই নিয়ে এসেছি। তুমি জলদি করে তাকে গোসল দিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও। কিছু মিষ্টান্ন খাইয়ে দিয়ে শিশুদের সঙ্গে খেলতে পাঠিয়ে দাও। হজরত ফাতেমা (রা.) শিশুটিকে নতুন কাপড় পরালেন। শিশুটি মনের আনন্দের দোলা বয়ে গেল, শিশুটি পেছনের দুঃখ ভুলে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল।

বিশ্বনবি (সা.)-এর সম্প্রীতির দুটি নমুনা আমরা দেখতে পাই, একটি নবুয়াতের আগের, অপরটি নবুয়াতের পরের-মক্কার বিবদমান সব গোত্রই পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণকে সৌভাগ্য ও মর্যদার প্রতীক মনে করত। কাজেই তারা সবাই মিলে বিবাদ বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাবা পুনঃনির্মাণ কাজ সমাধা করল। আগেই কাবাঘরের মাঝে স্থাপিত হয়েছিল জান্নাতি ‘শুভ্রপাথর’ যা পাপ শোষণের কারণে কালো হয়েছে যাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বলে। ওই পবিত্র পাথরখানা কাবাশরিফের যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে সব পক্ষই তীব্র দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কেননা এ প্রতিস্থাপন কর্মটি ছিল বড়ই মর্যাদার ও মহাগর্বের। তাই সব পক্ষ চাচ্ছিল এ গৌরব নিজেরাই অর্জন করুক। আসন্ন এ চরম কঠিন বিপদসংকুল ও সংঘাতময় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নবি (সা.) সম্প্র্রীতির বাতাবরণে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে একখানা চাদর এনে তার চতুষ্কোণ বিবদমান পক্ষগুলোর হাতে দিয়ে আর স্বয়ং নিজে ‘হাজরে আসওয়াদকে’ ওই চাদরে রেখে কাবায় গিয়ে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে মহাসংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করলেন। সব পক্ষই সন্তুষ্ট ও পরম খুশি হলো, সম্প্র্রীতি ও প্রীতিতে বলিয়ান হয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে আলিঙ্গন করল। সবাই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করল। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

ইসলামপ্রীতি ও সম্প্রীতির ধর্ম। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে (সা.) পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে সম্প্র্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ মানবিক পরিবেশ কায়েমের জন্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া-১০৭)। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর নবি (সা.) সেখানকার ‘আওস ও খাজরাজ’ গোত্রের মাঝে সম্প্রীতির আবহে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুললেন। তাদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সংঘাতকে তিনি শান্তির মহামিলনে উপসংহার টানলেন। মদিনায় মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অপরাপর ধর্ম বিশ্বাসীদের মাঝে সহাবস্থান তৈরি করেন। মদিনায় অসাম্প্র্রদায়িক, আদর্শ সমাজ, সুখি-সমৃদ্ধ আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তিনি ‘মদিনা সনদ’ নামক বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকরী করেন। যার ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে আগের ইয়াসরিব নগরী ‘মদিনাতুন্নবি’ নামে সম্প্রীতি ও প্রীতির আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে নতুন পরিচয় লাভ করে।

মানবতার নবি মুহাম্মাদ (সা.) হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে অনিবার্য রক্তক্ষয়ী সংঘাতকে সম্প্র্রীতির মাধ্যমে সমাধান করেন। তিনি মক্কাবিজয়ের পর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.