সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের নতুন ইতিহাস

সাফে প্রথমবার বাংলাদেশ ফাইনাল খেলেছিল ২০১৬ সালে। সেবার ভারতের কাছে হেরে শিরোপার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের। এবার তেমনটি হয়নি। ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়া পেয়েছে নতুন চ্যাম্পিয়ন। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব জিতে নিজেদের সংগ্রামের মূল্য পেয়েছেন দলটির নারী ফুটবলাররা, তাদের কাছ থেকে দেশ মাতৃকাও পেয়েছে দারুণ এক উপহার।

ফাইনালের দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন সানজিদা খাতুন। জাতীয় দলের এই ফরোয়ার্ডের বার্তায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ নারী দলের ফুটবলারদের কঠিন বাস্তবতার গল্প। এই দলের ৮-১০ জনের বাড়ি পাহাড়ি অঞ্চলে। বাকিদের বাড়িও বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

এদের বেশির ভাগের উপার্জনে চলে তাদের সংসার। সেটা জানিয়ে সানজিদা লিখেছিলেন, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো। জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে। তবে বিশ্বাস রাখুন, আমরা আমাদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবো না ইনশাআল্লাহ।’ তাদের ওপর বিশ^াস রেখেছে পুরো জাতি। তারাও সেই বিশ^াসের প্রতিদান দিয়েছেন। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ১৫ হাজার দর্শকের সামনে ১১ নারী লড়াই করেছেন বুক চিতিয়ে। গ্যালারির ভুভুজেলা আর বাদ্য-বাজনার উন্মাদনা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় শ্মশানের নীরবতায়। ফুটো বেলুনের মতো নেপালিদের চুপসে ইতিহাস রচনা করেছেন সানজিদারা। তাদের বিশ^াস, এই শিরোপা আগামী দিনে পথ দেখাবে নতুনদের। দেশ পাবে নতুন সাবিনা, কৃষ্ণা-মারিয়াদের।

শিরোপা জয়ের পর জীবন সংগ্রামের গল্প শুনিয়ে দলটির মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমরা লড়াই করেছি। এখন লড়াই করছি মাঠে। আজ যেমন নেপালের ১৫ হাজারের সঙ্গে আমরা ১১ জন লড়াই করে জিতেছি। জীবন যুদ্ধের লড়াই আমাদের এসব লড়াই জিততে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।’ যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন, তখন মারিয়ার বাবা মারা যান। বাবার চেহারা কেমন ছিল, একটুও মনে নেই। বাবার একটা ছবিও নেই যে দেখবেন মারিয়া। কখনো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করলে মায়ের মুখটা সবার আগে মনে পড়ে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার মেয়ে মারিয়ার। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে মারিয়াদের চার ভাইবোনকে নিয়ে মা এনতা মান্দার লড়াইয়ের শুরু। এখনো সেই একইভাবে লড়ে যাচ্ছেন মারিয়ার মা। মারিয়ার মা এনতা মান্দা ধানের মৌসুমে ধান লাগান, মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করেন। এসব করেই মারিয়াকে ফুটবলার বানিয়েছেন তার মা।

সাফের শিরোপা জিতে মায়ের সঙ্গে দেশ মাতৃকাকে এই উপহার দিলেন মারিয়া। জোড়া গোল করে শিরোপা জেতানো কৃষ্ণা রানী সরকারের গল্পও কণ্টকাকীর্ণ। টাঙ্গাইলের উত্তর পাথুলিয়া গ্রামে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কৃষ্ণা রানী সরকারের। পৃথিবীর আলো দেখার পর কখনোই সুখের মুখ দেখেননি। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই দেখেছেন বাবাকে কষ্ট করতে। দর্জির কাজ করে কোনো রকমে সংসারের খরচ চালাতে হতো বাবাকে। রান্নার চুলোয় গিয়ে দেখতেন ক্রন্দনরত মায়ের মুখ। অভাবের সংসার; ছোট ভাইকে নিয়ে ঠিক মতো খেতেও পেতেন না কৃষ্ণা। অর্ধাহার-অনাহারে দিনাতিপাত করেছেন। কিন্তু কোনো বাধাই দমাতে পারেনি তাকে। অদম্য ইচ্ছা শক্তি তার লক্ষ্য থেকে তাকে টলাতে পারেনি এক চুলও। প্রতিবেশীদের নানা কটূক্তি সহ্য করে আজ তিনি পরিণত হয়েছেন ১৬ কোটি মানুষের মাথার তাজে। মনিকা চাকমা, আঁখি, ঋতুপর্ণা চাকমাদের জীবনের গল্পও একই রকম। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এরাই আজ লিখেছেন রূপকথার গল্প। দেশ মাতৃকাকে দিয়েছেন দারুণ এক উপহার। মাকে এর চেয়ে ভালো কী উপহার দিতে পারতেন কৃষ্ণা-মারিয়ারা!

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.