সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করতে ইচ্ছুক ইউজিসি

বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সান্ধ্য, উইকেন্ড ও এক্সিকিউটিভ কোর্সগুলো বন্ধ করতে চায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। রাষ্ট্রপতির কাছে এক সুপারিশনামায় ইউজিসি বলেছে, এই কোর্সগুলোর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গত বৃহস্পতিবার ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে ১৭টি সুপারিশসহ ৪৮তম ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১’ জমা দিয়েছেন।

এ ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি রোধে ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’, আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ‘অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা ও আর্থিক ম্যানুয়াল’ প্রণয়ন, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পূর্ণ ক্ষমতা এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে ‘শিক্ষা ঋণ’ দেওয়ার সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

ইউজিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা অন্তত ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। নিয়মিত কোর্সের তুলনায় এসব কোর্সে অনেক বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। টিউশন ফির নামে নেওয়া হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে কোর্স ফির পরিমাণ এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর এ টাকার বেশিরভাগ যায় শিক্ষকদের পকেটে। তাই নিয়মিত কোর্সের চাইতে সান্ধ্যের বাণিজ্যিক কোর্সে শিক্ষকদের আগ্রহ বেশি থাকে।

সুপারিশনামায় ইউজিসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য, ভাবমূর্তি এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পরিপন্থি হওয়ায় কোর্সগুলো বন্ধ হওয়া জরুরি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী ইউজিসির পূর্বানুমোদনক্রমে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে ডিপ্লোমা, শর্ট কোর্স, ভোকেশনাল ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘এবার ভালো কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। উচ্চশিক্ষা খাতে চলমান ও স্থায়ী সংকট সমাধানে ১৭টি সুপারিশ করা হয়েছে।’

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের সুপারিশনামায় বলা হয়েছে, জ্ঞান বিতরণ, নতুন জ্ঞান সৃজন ও সংরক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মৌলিক কাজ। এ লক্ষ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ প্লান থাকা জরুরি। মানসম্মত ও বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দেশীয় বা জাতীয় র‌্যাংকিং করা প্রয়োজন। সুনীল অর্থনীতিকে সামনে রেখে বিশেষায়িত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্রবিজ্ঞান ও খনিজসম্পদ আহরণ সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন এবং এ খাতে বিশেষ গবেষণা তহবিল গঠনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

সনদ জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি জানিয়ে ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির সহায়তায় সার্টিফিকেট ব্লকচেইন রিপোজিটারিতে সংরক্ষিত হবে এবং সার্টিফিকেটের হার্ডকপিতে কিউআর কোড যুক্ত থাকবে, যা স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন বা ওয়েব অ্যাপ্লিকশন ব্যবহার করে সহজে যাচাই করা যাবে।

এ ছাড়াও প্রতিবেদনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করতে ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, উন্নতমানের গবেষণা করার জন্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি, গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে।

সুপারিশনামায় নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান, নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য ভূমির পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ এবং কোন পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারবে তার নীতিমালা তৈরির কথাও বলা হয়েছে।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস স্থাপন ও পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত তদারকির জন্য বিদ্যমান বিধিমালা ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা-২০১৪-এর সংশোধন করার যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে, তা দ্রুত সম্পন্ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

ইউজিসি নিয়মিতভাবে একাডেমিক, সিন্ডিকেট, আর্থিক এবং বোর্ড অব ট্রাস্টির সভা না করার জন্য বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেননি। এমনকি অনেকেই তাদের আর্থিক প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিতে নারাজ। অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি বা প্রো-ভিসি নিয়োগের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির পরামর্শ অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.