‘শুধু আওয়ামী লীগের সময়েই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়’

বিবিসিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ইপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির লরা কুয়েন্সবার্গকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। ১৮ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়।

সাক্ষাৎকারে রানি এলিজাবেথকে নিয়ে স্মৃতিচারণের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন ও গুমের অভিযোগ নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাশাসক দেশ শাসন করেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ব্যবহার করেছে। দেশে শুধু আওয়ামী লীগের সময় নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা তার সংগ্রাম।

রানির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি যুক্তরাজ্যের রানি ছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তিনি কমনওয়েলথেরও নেতা ছিলেন। তাই কমনওয়েলথের সদস্য দেশ হিসেবে তিনি আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ৭০ বছর ধরে সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন এবং আমি মনে করি, বিশ্বে তিনি শুধু রানিই ছিলেন না, একজন মমতাময়ী, মাতৃসুলভ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যখনই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, আমি সেটা অনুভব করেছি। ’

প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :

বিবিসি : তাঁকে (রানি) ঘিরে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো কী?

প্রধানমন্ত্রী : ১৯৬১ সালে রানি যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন, তখন তাঁকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমরা তখন ছোট ছিলাম। আমরা বাবার অফিসে ছিলাম, কারণ আমরা জানতাম যে, তিনি ওই রাস্তা দিয়ে যাবেন। আমাদের পুরো পরিবার হাতে বাইনোকুলার নিয়ে; জানালায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল, যেন আমরা তাঁকে ভালোভাবে দেখতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সঙ্গে প্রতি সফরেই আমার দেখা হয়েছে। আমি সাতটি কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। প্রতিবারই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে এবং অলিম্পিক গেমসের সময়ও তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, আমি এসেছিলাম। সেটিও খুব ভালো একটি সুযোগ ছিল, আমরা দীর্ঘ সময় আলোচনা করেছিলাম।

বিবিসি : তাহলে তো কয়েক দশকে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে আপনার। যখন শিশু ছিলেন তখন আপনার বাবার অফিসে, এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে অনেক কমনওয়েলথ সম্মেলনে। তিনি আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অনেক দশক ধরে।

প্রধানমন্ত্রী : তার (রানি) স্মৃতিশক্তি ছিল চমৎকার। কমনওয়েলথ সম্মেলনে তিনি যখন আমাকে দেখতে পেতেন না, তখন খোঁজ নিতেন- ‘হাসিনা কোথায়? আমি তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না?’

বিবিসি : কমনওয়েলথ আপনার কাছে ও বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

প্রধানমন্ত্রী : আমরা একত্রে থাকলে অনেক সুযোগ তৈরি হয়। সুতরাং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের জন্য, নতুন আইডিয়া পাওয়ার জন্য বা দেশ ও মানুষের জন্য ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরি হয় কমনওয়েলথে। সুতরাং আমি মনে করি, এটি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে একটি দেশ একা এগিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবীতে সবাই পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং এ রকম পরিস্থিতিতে সদস্য দেশগুলোর জন্য কমনওয়েলথের গুরুত্ব অনেক। আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করতে পারব। কারণ এখানে উন্নত, উন্নয়নশীল, দরিদ্র বা ছোট দ্বীপ দেশ- সবই রয়েছে।

বিবিসি : আপনার দেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আসেন, এখানে জীবন যাপন করেন। আপনার দেশে নিযুক্ত প্রয়াত রানির হাইকমিশনার আপনার সরকারের কাছে আগামী বছর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার চেয়েছেন। আপনি কি এই অঙ্গীকার করবেন?

প্রধানমন্ত্রী : দেখুন, আমার দেশে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসক ছিল। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই হোক আর প্রকাশ্যে বা গোপনেই হোক। ১৯৭৫ সালে যখন আমার বাবাকে হত্যা করা হয়, তখন তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আপনি জানেন, আমার পুরো পরিবার- আমার মা, ভাইয়েরা, তাদের স্ত্রীরা এবং অন্য সদস্যরা; মোট ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। তখন থেকে পরের ২১ বছর পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় আমাদের দেশে সামরিক শাসন ছিল, অনেকবার। প্রায় ২০ বার সক্রিয় অভ্যুত্থান হয়েছিল, প্রতিবারই রক্তক্ষয় হয়েছে। কোনো গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। আমার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আমার সংগ্রাম করতে হয়েছে।

বিবিসি : কিন্তু জাতিসংঘ ও রানির হাইকমিশনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করতে আপনার সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। আর গুমের অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘ কথা বলেছে।

প্রধানমন্ত্রী : অনেক মানুষই অভিযোগ তুলতে পারে। কিন্তু তার কতটুকু সত্যি, তা আপনাকে বিচার করতে হবে। তার আগে কারো কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। কারণ আমি আপনাকে বলছি, সেনাশাসক দেশ শাসন করেছে। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তারা কখনো মানুষের কাছে গিয়ে তাদের জন্য ভোট চায়নি। তারা সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ব্যবহার করেছে, শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য। শুধু আওয়ামী লীগের সময় আপনি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে পাবেন।

বিবিসি : আমি স্পষ্টভাবে শুনেছি যে, আপনি সেসব নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে অঙ্গীকার করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী : অবশ্যই, এটা আমার সংগ্রাম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা আমার সংগ্রাম।
বিবিসি : গুমের অভিযোগ যেসব পক্ষের বিরুদ্ধে রয়েছে, আপনি কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন? এ বিষয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী : আপনার দেশে বা অন্য দেশে কত মানুষ হারিয়ে যায় তা আপনি বিচার করতে পারেন। এ বিষয়ে আমি মনে করি, প্রথমে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপর তারা অভিযোগ করতে পারে।

বিবিসি : শেষ প্রশ্ন, শেষকৃত্যাষ্ঠান অনেক বড় একটি বৈশ্বিক আয়োজন। যখন আপনি এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাবেন, তখন আপনার কী চিন্তা থাকবে বলে মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী : অবশ্যই আমরা রানিকে ভালোবাসি। তিনি অত্যন্ত মমতাময়ী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, আমি ভাগ্যবান যে, তিনি সব সময় আমার নামও মনে রাখতেন। আমি এখানে এসেছি তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

বিবিসি : আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রধানমন্ত্রী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.