শিক্ষক দিবস নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন

প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সংস্থাটি প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘পরিবর্তনশীল গতিপথ রুপান্তরিত শিক্ষা’। তাই এ বছরে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসকে নতুনভাবে দেখতে ও ভাবতে হবে।

শিক্ষকতা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। তার ওপর তাঁদের কাজ করতে হয় অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে। সমস্যা সব দেশেই কমবেশি আছে। আমাদের সমস্যা হয়তো বা কিছুটা বেশি। তবে এর মধ্যেও আমাদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষকদের অধিকারের কথা যেমন ভাবতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের অধিকার যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকটার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তানের মতো। শত প্রতিকূলতা, সংকট আর বাধাবিপত্তির মধ্যেও তাদের এগিয়ে নিতে হবে। স্বপ্নের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে তাদের স্বপ্নবাজ করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বঞ্চনার প্রভাব তাদের ওপর কোনোভাবেই যাতে না পড়ে, তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এই মানসিকতাটা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই তারা জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

বিশ্বে যেসব শিক্ষক স্মরণীয় বরণীয় হয়েছেন, তাঁরা যেমন লড়াই করেছেন, তেমনি ধৈর্য আর ত্যাগের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস মূলত একজন শিক্ষক ছিলেন। তার এই শিক্ষাদানের পেছনে জাগতিক কোনো চাওয়া পাওয়ার বিষয় না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে এথেন্সের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। এতে সক্রেটিসের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং সারা বিশ্বে তিনি আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্মরণীয় ও বরণীয় এক দার্শনিক ও শিক্ষকের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন।

আমাদের সমাজেও যেসব শিক্ষক নিঃস্বার্থভাবে একটু গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে থাকেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে স্মরণীয় ও বরণীয় হন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে সম্মান পান। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সমাজে বেশি সম্মান পান। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি অন্য রকম মনে হয়। তাঁরা সম্মান পান ঠিকই, তবে ব্যক্তি হিসেবে নন, মানুষ সম্মান করেন তাঁদের পদকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পদ চলে যাওয়ার পর তাঁদের সম্মানও চলে যায়। কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষকের সম্মান কোনোদিনই কমে না। এমনকি মৃত্যুর পরও না। তবে এমন আদর্শ মানে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার অপরিহার্য।

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে, তবে শিক্ষকেরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। সম্মান-শ্রদ্ধা যেমন জোর করে আদায় করা যায় না, অন্যদিকে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা-সম্মান জ্ঞাপনকেও কোনো তৃতীয় শক্তি বাধা দিয়ে রুখতে পারে না। শিক্ষকেরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শুধু শিক্ষকগণের নয়, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রের সব ধরনের সমস্যা ও অসামঞ্জস্য দূর করে একটা পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে আমাদের এসডিজি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাই শিক্ষকদেরই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে পরিবেশ তৈরিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে।

আজকের শিক্ষার্থীই আগামী দিনের শিক্ষক। শিক্ষকরাই মানবগড়ার কারিগর। পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদাশীল এবং দায়িত্বপূর্ণ পেশা হলো শিক্ষকতা। অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত অভিভাবকগণও অহরহ বলে থাকেন শিক্ষকতা মহৎ পেশা এবং পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠ পেশার লোকদের বৈশিষ্ট্যগুলোও শ্রেষ্ঠ। তাই তাঁদের সন্তানদের শ্রেষ্ঠ ও বড় কিছু একটা হওয়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষকদের কাছে পাঠান। তাঁরা মনে করেন একজন শিক্ষক অবশ্যই অনুকরণীয় হবেন, তিনি শালীন, মার্জিত ও ব্যক্তিত্বরক্ষাকারী পোশাক পরিধান করবেন, আদর্শবান হবেন, আদর্শিক জ্ঞানের অধিকারী হবেন, উত্তম আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন, কথা ও কাজে মিল রাখবেন, আদর্শ প্রচারে কৌশলী ও সাহসী হবেন। শিক্ষকতাকে তাঁরা পেশা ও নেশা হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন হবেন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন, ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসাসম্পন্ন হবেন, নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করবেন, ক্লাসে পড়ানোর জন্য আগেই প্রস্তুতি নেবেন, মেধা বিকাশে সহায়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, স্নেহ-মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন, সকল শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখবেন, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান লাভে উৎসাহিত করবেন, শাসন করবেন, তবে নির্মমতা প্রদর্শন করবেন না- বরং দরদি মন নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। শিক্ষকরা বিচক্ষণ হবেন, ছাত্রদের মন-মেজাজ পছন্দ-অপছন্দ ও কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন, মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখবেন, নিয়মনীতির ক্ষেত্রে কঠোর হবেন, সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হবেন এবং অভিভাবকের জায়গায় নিজকে স্থান দিয়ে দেখাশোনা করবেন।

শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ হলো পাঠ্যবই পড়া। অবসর সময়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় গ্রন্থ, শিক্ষামূলক গল্প, মনীষীদের জীবনী, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ে জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। নিজ দেশ সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পড়া, মা-বাবা, ভাই-বোনের সাহায্য নিয়ে যে বিষয়টি ক্লাসে বুঝতে অসুবিধা তা শিখে নেয়া, বুকশেলফে পড়ার উপযোগী বই থাকলে সেগুলো পড়ে ফেলা, ওয়েবসাইটে থাকা উপযোগী পাঠসামগ্রী প্রয়োজনে ডাউনলোড করে নেয়া, রুটিনমাফিক খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা, প্রার্থনা, শরীরচর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি সম্পন্ন করা। ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের বড় কাজ হলো পিতামাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি করে কৃষিকাজে পিতাকে সাহায্য করতে পারে। এতে পরিবার উপকৃত হয় এবং নিজেরাও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ফলে পিতা-মাতা, কৃষক, জেলে, শ্রমিক, মজুর, কামার, কুমার সকল শ্রেণির মানুষের প্রতি দরদ তৈরি হয়। বর্তমানে প্রতিটি পরিবারেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। টিভি দেখা, গান শোনা ও মুভি দেখার ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় মুভি দেখতে নির্দেশনা দিতে হবে।

জন্মের পর একটি শিশুর শিক্ষাগ্রহণের প্রথম পাঠ শুরু হয় তার পরিবারে। অতপর তার শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। এই শিক্ষাদান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্কের এক অটুট বন্ধন। যে সম্পর্কের সামনে শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় মাথা নত করি আমরা সবাই। আগের দিনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে শ্রদ্ধা করত দেবতার মতো। শিক্ষকের এক একটি আদেশ-উপদেশকে তারা বেদবাক্য বলে মনে করত। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের ভালবাসত আপন সন্তানের মতো। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের নজির স্থাপনকারী বাদশা আলমগীরের কথাও আমরা জানি। কয়েকদিন পূর্বে একটি দৈনিক পত্রিকায় পড়েছিলাম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় আশুলিয়া জয়নাথ চক্রবর্তী হাইস্কুল নামে একটি স্কুল আছে। জয়নাথ চক্রবর্তী ছিলেন স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধান শিক্ষক। এ স্কুলে পড়ালেখা করেছেন তারই একজন ছাত্র এক সময় সরকারের বড় পদে আসীন হয়েছিলেন। তিনি যখন তার গ্রামের বাড়িতে যেতেন এ স্কুলের সামনে দিয়ে তাকে যেতে হতো। স্কুলের সামনের রাস্তাটুকু ছিল মাটির কাঁচা রাস্তা। স্কুলের অদূরে গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের সামনে কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাড়িতে যেতে হতো। এ ভদ্রলোককে যতবারই স্কুলের সামনে দিয়ে তার বাড়িতে যেতে দেখা গেছে, ততবারই আমৃত্যু তিনি স্কুলের কাছে দিয়ে পায়ের জুতা হাতে নিয়ে স্কুলগেট অতিক্রম করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘গেটটিতে তার শিক্ষকের নাম লেখা রয়েছে। এ নামের প্রতি সম্মান জানাতেই তিনি পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিতেন।’

শিক্ষক জ্ঞানদাতা, তাই বলে তিনি কেবল দিয়েই যাবেন তা নয়। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের সব চেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো শিক্ষার্থীরা তার দেয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই ভাল মানুষ হবে। তাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে, উপযুক্ত মর্যাদা দেবে। তাকে ভালবাসবে এবং তার প্রতি অনুগত থাকবে। সম্প্রতি সরকার গৃহীত শিক্ষাক্রম মোতাবেক একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু। তা ঠিক, কিন্তু শিক্ষার্থীরা যা খুশি তা করবে বিষয়টি এমন নয়। ছাত্ররা তাদের মনের কথা খুলে বলতে পারবে এবং শিক্ষক তা শুনে বন্ধুর মত সুপরামর্শ দেবেন। শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষককে যথাযথ সন্মান না করে তাহলে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারবে না। শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্ররাই প্রকৃত জ্ঞানের আলো পায়। শিক্ষার্থীর সঙ্গে যখন শিক্ষকের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, তখন শিক্ষক হয়ে উঠেন বিশ্বস্ততার জায়গা।

আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে খুব একটা সম্মানজনক অবস্থায় নেই, সেটা সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যদি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সম্পর্কের উন্নতি না হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর সেমিনার বা কর্মশালার আয়োজন করলে ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয়। শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা, অযত্ন ও অবজ্ঞার ফলে এই পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ বিশ ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর আগেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। শিষ্য যে ভক্তি নিয়ে গুরুকে সমীহ করতেন, গুরুরাও সেই মর্যাদা ধরে রাখতে নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পড়াশোনা করতেন ও আদর্শবান হতেন। শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটা আগের তুলনায় অনেকটাই হারিয়ে গেছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিক্ষা হয়ে গেছে চাকরি পাওয়ার সিঁড়ি। শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে বলেই শিক্ষকের ক্লাস শেষ করে এসে তার কাছে আবার প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। একই স্কুলে অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীর নিকট থেকে বছর বছর জোর করে সেশন ফি বা ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে ইত্যাদি।
শিক্ষকগণ আসলে শিক্ষাদানের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ করছেন। বেশির ভাগ শিক্ষক মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। যে পেশায় থাকলে পশুতুল্য শিশুকে মানুষ বানানো যায়, শিশুর মধ্যে মান-সম্মানবোধ জাগ্রত করা যায়। শিক্ষকরা কতটা নিঃস্বার্থ হতে পারে নিচের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। কোনো শিক্ষক যদি এসএসসি পাস হয়ে থাকেন, উনি সর্বক্ষণ দোয়া করেন তাঁর ছাত্ররা যেন দুনিয়ার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। আবার কোনো শিক্ষক যদি তৃতীয় বিভাগে পাশ করা শিক্ষক হয়ে থাকেন উনিও সবসময় কামনা করেন তাঁর ছাত্ররা যেন প্রথম শ্রেণিতে উর্ত্তীর্ণ হতে পারে। কিন্তু অন্য পেশায় তা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। শেখ সাদী প্রার্থনা করেছেন, হে খোদা, তুমি আমাকে আদব শিক্ষা দাও যেহেতু বেয়াদব তোমার অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত। রাসুল (সা:) বলেছেন, ‘অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব-কায়দা অনেক বেশি উত্তম। কোনো ব্যক্তি জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।’

বর্তমানে শিক্ষকদের উন্নয়ন ও শিক্ষার উন্নয়ন যে আদলে চলছে, তাতে পুরো শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের খুব ভালো কিছু দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য যে সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও মানসম্মত প্রশিক্ষক ও তাঁদের পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা বা মনিটরিং নিশ্চিতকরণে যথাযথ কোনো উদ্যোগ না নিলে অচিরেই শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির পরিবর্তে অবনয়ন হবে এবং ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এসডিজি ফোর অর্থাৎ গুণগত শিক্ষা অর্জন কেবলই প্রচারণায় সীমাবদ্ধ থাকবে। একটি প্রবাদ আছে, একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে আধুনিক মারণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। কেবল শিক্ষা ব্যবস্থায় অনিয়ম করে দিলেই সর্বত্র অযোগ্য শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, প্রশাসক, ব্যবসায়ী তৈরি হবে দেশ এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। অবস্থার পরিমার্জন করতে হলে শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে হবে। ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার বদলে সাপ্তাহিক ক্লাস টেস্টের মতো সৃজনশীল পরীক্ষা নিতে হবে।

পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। আমাদের দেশে সরকারিভাবে অনেক দিবসই পালন করা হয়। এসব দিবস পালনের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদেরও উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু সুষ্ঠু ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’টি সরকারিভাবে পালন করা হয় না। এই দিবসটি সরকারিভাবে পালন করলে শিক্ষক অবশ্যই নিজেদের সম্মানিত বোধ করতেন, যা তাঁদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করত। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন আশা করি।

লেখক : অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন, টিম লিডার, পদ্মা সেতু জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম ও সাবেক মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.