বাংলা একাডেমির নতুন সভাপতি সেলিনা হোসেন

বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পেলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩’-এর ধারা-৬(১) এবং ৬(৩) অনুযায়ী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে সেলিনা হোসেন এ নিয়োগ পেয়েছেন। যোগদানের তারিখ থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যে সেলিনা হোসেন একটি স্বতন্ত্র নাম। একটি মূল্যবান নাম। যে নামটি এক বাক্যে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয় পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার অগণিত পাঠকের কাছে। বর্তমানে তাঁর লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ৪৩টি। গল্পগ্রন্থ ১৬টি। প্রবন্ধ ১০টি। শিশু সাহিত্য ৩৫টি। ভ্রমণ কাহিনী একটি। প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৫টি ।

পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের লেখা গল্প-উপন্যাস। সেলিনা হোসেনের ১১টি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে । পাশাপাশি ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, রুশ, উর্দু, হিন্দি, মালয়ালাম, মারাঠি, ফিনিস, আরবি, অসমিয়া, উড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাস। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী ভাষায় তাঁর গল্প -উপন্যাস অনুবাদের কাজ চলছে।

হাঙ্গর নদী গ্রেনেড কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এই উপন্যাসের পটভূমি হল মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জের একজন মা দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে তাঁর নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। ১৯৮৭ সালে হাঙর নদী গ্রেনেড ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এই উপন্যাসটি ২০০৩ সালে ভারতের মালয়ালম ভাষায় অনূদিত হয়ে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়।

২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে দুই সেমিস্টারে পাঠ্য ছিল হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। পরবর্তীতে হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদ করেন বাংলাদেশ থেকে জ্যাকি কবীর। সেই পান্ডুলিপি পরিমার্জন করেন প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচার-এর অধ্যাপক পাস্কেল জিন্‌ক। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি “রিভার অব মাই ব্লাড” নামে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়।

হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য। হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে তিনটি চিঠি লিখেন। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি চেয়ে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে ছবিটি নির্মাণ না করতে পারার কারণে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম হাঙ্গর নদী গ্রেনেড চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।

সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন এক জীবনীভিত্তিক উপন্যাস। চর্যাপদে প্রাচীন সমাজের শিকড়ের সাথে যে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ছিল তার সামগ্রিক চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে । ১৯৮৩ সালে নীল ময়ূরের যৌবন ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় । পরবর্তীতে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল ময়ূরের যৌবন পাঠ্য করা হয় ।

১৯৯৯ সালে টানাপোড়েন উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় এবং ২০০৩ সালে টানাপোড়েন উপন্যাসটি উর্দুতে অনূদিত হয়ে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয় ।

২০১২ সালে পূর্ণ ছবির মগ্নতা উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়। ২০১৮ সালে পূর্ণ ছবির মগ্নতা উপন্যাসটি অসমিয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে গৌহাটি থেকে প্রকাশিত হয়। পূর্ণ ছবির মগ্নতা সেই সময়কার ঘটনা যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখভাল করার জন্য শিলাইদহ,পতিসর, শাহজাদপুর এসে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতি প্রেম নিয়ে লেখা পূর্ণ ছবির মগ্নতা বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় সিংহলী ভাষায় অনূদিত হচ্ছে।

সেলিনা হোসেনের নারীর রূপকথার গল্প উড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে উড়িষ্যা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা মোহিনীর বিয়ে মালিয়ালাম ভাষায় অনূদিত হয় ২০০১ সালে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়।

আসাম বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্য হয়েছে গায়ত্রী সন্ধ্যা। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তে সেলিনা হোসেন সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে পঁচাত্তর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়কে তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাসে।

এই উপন্যাসে নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এগারো দফা, গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণানা করা হয়েছে।

দেশভাগ এবং বৈষম্যের শিকার একটি সাধারণ পরিবারের কাহিনী ও দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ববাংলার জীবনচিত্র নিয়ে তাঁর যাপিত জীবন উপন্যাসটি রচিত। যাপিত জীবন উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য।

নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি- বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত একটি উপন্যাস । নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য ।

জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে বাংলা বিভাগে তাঁর দুটি গল্প পাঠ্য।

২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়, কোচবিহার ইউজিসি পাঠ্যক্রমে আমিনা মদিনার গল্প পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয় । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫ টি কলেজ আছে।

২০১৮ কাঠ কয়লার ছবি উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়। কাঠ কয়লার ছবি একটি লস্ট আইডেনটিটির গল্প। উপন্যাসটি একাত্তরের যুদ্ধশিশু এবং সিলেটের চা শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে লেখা। কাঠকয়লার ছবি উপন্যাসটি সম্প্রতি দিল্লী ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য করা হয়েছে ।

নাচলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নারীনেত্রী ইলামিত্রকে নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ উপন্যাস কাঁটাতারের প্রজাপতি।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় জেন্ডার স্টাডিস বিভাগে সেলিনা হোসেনের ঘরগেরস্থের রাজনীতি গ্রন্থ পাঠ্য।

২০১৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী সেলিনা হোসেন উপন্যাসের বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.