বন্যায় ত্রাণ নিয়ে এলো ‘জল-রোবট’ নাবিক নাবিক!

আলাস্কার উত্তরে ‘বিউফোর্ট’ সাগরের বরফগলা পানিতে জড়ো হয়েছেন ‘নাসা’র একদল প্রকৌশলী। হিমশীতল বাতাসে চোখমুখ ঢেকে তাঁরা তাকিয়ে আছেন একটি সুড়ঙ্গের দিকে, সামনেই বরফ ভেদ করে সোজা নিচে নেমে গেছে বরফ কেটে তৈরি করা সেই সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ দিয়ে নলাকার এক রোবট চলে যাচ্ছে হিমশীতল সমুদ্রের নিচে। রোবটটি অ্যান্টার্কটিকার রহস্যময় ও গলে যাওয়া বরফের বিভিন্ন তাক থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে।

২০২৪ সালের মার্চ মাসে আলোচনায় আসা এই রোবটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবিত রোবট ‘নাবিক’।

নাবিক একটি জল-রোবটের নাম

জল-রোবট ‘নাবিক’-এর কারিগর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাবিক অটোমেশনস’ দল। বিশ্ববিদ্যালয়টির তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ফারদিন খান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মাশরুজ্জামান প্রতিষ্ঠানটির সূচনা করেন ২০২২ সালে। তাঁদের গাইড হিসেবে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আদিল হোসেন।

বর্তমানে ‘নাবিক’-এর নিজস্ব একটি দল রয়েছে। এই দলের সদস্যদের মধ্যে আছেন আদিল হোসেন, ফারদিন খান, মাশরুজ্জামান, মো. সাকলাইন নেওয়াজ, ফারিয়ান শাহ ফাহী, ভুবন মজুমদার, মিফতাহুল জান্নাত, মুনতাসির আব্দুল্লাহ বিন আহমেদ ও আবু অহন রহমান। সমুদ্রকেন্দ্রিক রোবটিকসশিল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে একটি বহুজাতিক (বাংলাদেশ ও কানাডা) স্টার্টআপ হিসেবে নাবিক অটোমেশনেসর যাত্রা শুরু হয়। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সমুদ্রকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া ব্যক্তিদের সহযোগিতায় তারা কাজ করতে থাকে পুরোদমে।

নাবিক অটোমেশনসের দলনেতা ফারদিন খান বলেন, “‘নাবিক’ নামটি এসেছে আমাদের মূল দল ‘নাবিক অটোমেশন’ থেকে। তবে নাবিক অটোমেশন নামের পেছনে আছে একটি গল্প। নাবিকরা সমুদ্রে একটি জাহাজের কান ও চোখ। তাঁরা পথ দেখিয়ে একটি জাহাজকে গন্তব্যে নিয়ে যান। ঝড়, বাতাস, ঢেউ ইত্যাদি কেটে কেটে জাহাজকে যেমন তাঁরা গন্তব্যে নিয়ে যান, আমাদের সিস্টেমটিও তাঁদের মতো নেভিগেশন ক্ষমতাসম্পন্ন করে বানানো।

এই কারণে এ রকম নামকরণ। এটি জাহাজের নাবিকের কাজ অনেকটা কমিয়ে দিতে পারবে।”

বন্যায় ত্রাণ নিয়ে হাজির

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে সংঘটিত বন্যায় যখন ত্রাণসামগ্রী আটকে পড়া মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না, তখন এগিয়ে আসে ‘নাবিক’। ফেনী জেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের সিলোনিয়া বাজার এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে তারা। যেসব স্থানে অতিরিক্ত পানি ও স্রোতের কারণে নৌকা ও স্পিডবোট পৌঁছতে পারেনি, সেখানে সফলভাবেই ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করতে পেরেছে ‘নাবিক’। রোবটটি প্রায় ৬০ কেজি ওজন বহন করতে পারে এবং দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তিন ঘণ্টা কাজ করতে সক্ষম। সরু পথ বা আঁটসাঁট জায়গা, অতিরিক্ত পানি-গাছের ডাল ভেঙে যেখানে নৌকা আটকে যায় সেখানে সবচেয়ে সহজে কাজে লাগানো গেছে ‘নাবিক’ রোবটকে। দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির অনেক আগে থেকেই ‘নাবিক’ রোবটের কাজ শুরু করেছিল ‘নাবিক অটোমেশনস’। ডুবোজলের রোবট নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করার ফলে আগে থেকেই তাদের একটি রোবটের প্রাথমিক অংশ প্রস্তুত ছিল। ফারদিন ও মাশরুজ্জামানের দলের হাতে এরই মধ্যে সারফেস ওয়াটার ও আন্ডারওয়াটার রোভারের প্রকল্প আছে। এবারের ভয়াবহ বন্যায় কিভাবে এটি কাজ করল? এই প্রশ্নের জবাবে ফারদিন খান বলেন, ‘২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পানি সম্পর্কিত সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছি। তবে তার আগে দেখেছি মানুষের সুরক্ষা কিসে আছে। আমরা আদৌ জানতাম না দেশের বন্যা পরিস্থিতিতে নাবিক রোবট এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। রোবটটির বর্তমান কাঠামো আমাদের আগে তৈরি করা প্রকল্প থেকে নেওয়া হলেও বন্যা পরিস্থিতির জন্য একে শতভাগ উপযোগী করতে টানা তিন দিন বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে।’

নাবিক অটোমেশনের আউটরিচ বিভাগের আবু অহন রহমান বলেন, ‘আমাদের রোবটগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের উপযোগী করে বানানো, সে ক্ষেত্রে বন্যা খুব বেশি চ্যালেঞ্জ হিসেবে তা মনে হয়নি। তবে এটি আমাদের প্রথমবারের মতো বাস্তব জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করেছিল, যা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। বর্তমানে আমরা আরো ভালো পরিকল্পনা এবং উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা চালাব।’

বন্যার পানির জন্য দেশের নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় নাবিক রোবটকে উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ ও বুটস্ট্র্যাপ করেছিল দলটি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় রোবটিকস ক্লাব প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে তাদের। দিয়েছে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ল্যাব সুবিধা।

ভবিষ্যৎ ভাবনা

নাবিকের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সম্পূর্ণরূপে ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের তৈরি। হার্ডওয়্যার ডিজাইন, চিপস এবং অন্যান্য উপকরণ নিজেরাই কাস্টমাইজ করে নিয়েছে তারা। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম ব্যবহার করে পানির মধ্যে নাবিক নিজেই নেভিগেট করতে পারে। বেসিক রিমোটের মাধ্যমে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে থেকে খুব সহজে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নাবিকে লাগানো আছে এফপিভি (ফাস্ট পারসন ভিউ) ক্যামেরা। এই ক্যামেরায় ভেসে আসা ছবি রোবটটিকে অপারেট করতে সাহায্য করে। দেশীয়ভাবে ডেভেলপ করার কারণে নাবিক বেশ সাশ্রয়ী। ভবিষ্যতে জাহাজ ও ডকের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার আশা এটির পেছনের মানুষগুলোর। রোবটের সাহায্যে কাজ করলে সময় ও ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে দুর্গম এলাকায় আটকে পড়া মানুষের খোঁজ নেওয়া সহজ হয় এবং যেকোনো তথ্য পৌঁছানো যায়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের উদ্যোগটিকে গতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে নাবিক অটোমেশনস।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.