দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খিলজির সেই অভিনব কৌশল

সাআদ তাশফিন

ভারতবর্ষের ইতিহাসের শক্তিশালী নাম আলাউদ্দিন খিলজি। যাঁকে খিলজি বংশের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারো কারো মতে, তিনি একজন স্বৈরাচারী হলেও অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি যুদ্ধ বিজেতা ও প্রশাসক হিসেবে সুলতানি আমলে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক সংস্কারের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে তিনি ছিলেন মধ্যযুগের ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি ১. জমি জরিপ করেছিলেন, ২. জায়গির দান বা ভূমিদান প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়েছিলেন, ৩. উচ্চহারে রাজস্ব ও কর ধার্য করেছিলেন এবং ৪. বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির অর্থনৈতিক সংস্কার তাঁর শাসনব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর জন্য ঐতিহাসিক লেনপুল তাঁকে একজন মহান রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজি মোঙ্গল আক্রমণ মোকাবেলা ও রাজ্য জয়ের জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী প্রতিপালন করতেন। সুলতান একজন অশ্বারোহী সৈনিকের বার্ষিক বেতন ২৩৪ টাকা নির্ধারণ করেন এবং কোনো সেনার একটি অতিরিক্ত ঘোড়া থাকলে তাকে বছরে আরো ৭৮ টাকা বেশি দেওয়া হতো।
সুলতান আরো বুঝতে পারেন, এত বড় সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার হ্রাস করার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য নির্ধারণ অথবা সেনাদের বেতন বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ সামরিক বাহিনীর স্বার্থেই সুলতান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ চালু করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়তে থাকলে সেনারা নির্ধারিত বেতনে কাজ করতে পারবে না। এই উদ্দেশ্যে সুলতান নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির বাজারদর নির্দিষ্ট করে দেন।

যুদ্ধকালীন দ্রব্যাদির অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শস্যের বাজার প্রায়ই চড়া থাকত। আলাউদ্দিন খিলজি এই সমস্যা দূরীকরণে দিল্লি ও এর আশপাশে রাজকীয় শস্যভাণ্ডার নির্মাণ করে সেখানে খাদ্যশস্য মজুদ করতেন, যাতে অভাবের সময় কম মূল্যে ওই খাদ্যশস্য বাজারে ছাড়া যায়। সুলতানের আদেশমতো খাদ্যশস্য রাজকীয় শস্যাগারে জমা করা হতো। বিভিন্ন এলাকা থেকে শস্য আমদানি করার জন্য ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য, কাপড়চোপড়, ঘোড়া এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশু, এমনকি দাস-দাসীরও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতাভুক্ত হয়। এই আইন যথাযথভাবে পালনের জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থা সঠিকরূপে পালিত হচ্ছে কি না, তা তদারক করার জন্য সুলতান একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি মুসলমান-হিন্দু সব ব্যবসায়ীকে তালিকাভুক্ত করেন।

মূল্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে কার্যকর করা ও বাজার তদারকির জন্য সুলতান আলাউদ্দিন দিওয়ান-ই রিয়াসাত ও শাহানা-ই মান্ডি উপাধিধারী দুজন পদস্থ কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। তাঁদের অধীনে নিযুক্ত নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীও বাজার পরিদর্শন করত। এসংক্রান্ত কঠোর আইন প্রণয়নের ফলে পণ্যদ্রব্যের দাম কমে যায়। একটি প্রথম শ্রেণির ঘোড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকায়, একটি দ্বিতীয় শ্রেণির ঘোড়া ৮০ থেকে ৯০ টাকায় এবং তৃতীয় শ্রেণির ঘোড়া ১০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। একটি দুগ্ধবতী গাভি তিন-চার টাকায় পাওয়া যেত এবং অনুরূপভাবে সব ব্যবহার্য জিনিসের দামও কম ছিল।

এ ছাড়া ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে সঠিক মাপে পণ্য ক্রয় নিশ্চিত করতে সঠিক ওজন দেওয়ার প্রতি কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোনো ব্যবসায়ী ওজনে কম দিলে তার শরীর থেকে অনুরূপ ওজনের মাংস কেটে নেওয়া হতো, ফলে দোকানিরা ওজনে কম দিত না। অসদুপায় অবলম্বনের অপরাধে দোকানিদের প্রকাশ্যে বাজারে অপমান করা হতো এবং তাদের শারীরিক নির্যাতনও করা হতো। সুলতান নিজেও মাঝে মাঝে বাজার তদারক করতেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ এবং শাসন সংস্কার অত্যন্ত সফল হয়। তিনি সুদক্ষ সেনাবাহিনীর সাহায্যে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাজা ও সর্দারদের কঠোর হস্তে দমন এবং বিদ্রোহ ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সারা দেশে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনসাধারণ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে। দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হওয়ার এবং প্রচুর জিনিসপত্র বাজারে আমদানি হওয়ার ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। (তথ্যঋণ : ইসলামী বিশ্বকোষ : ৩/১৭৬)

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.