জাপানের শ্রমবাজার: বাংলাদেশিদের জন্য সম্ভাবনা

কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বন্ধন আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশ বাংলাদেশ ও জাপান। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাপান। এর পর থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে দেশটি। জ্বালানি, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, অবকাঠামো, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে জাপান এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৪২৫ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতা এসেছে দেশটি থেকে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। ২০২৬ সাল নাগাদ নি¤œ আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম মূল খাত প্রবাসী-আয়। গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের বাংলাদেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আসে প্রবাসী-আয় থেকে, যার পরিমাণ প্রায় দুই হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশকে বিশ্বের অষ্টম রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ হিসেবেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম তরুণ, যারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছেÑশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত এই তরুণদের অধিকাংশই বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড ইমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক, ২০২১’-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বেকারত্বের হার প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ (২০২০) এবং এই হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো কভিড মহামারি চলাকালে দেশের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়া। তবে বাংলাদেশের জন্য বড় সুখবর হচ্ছে, কভিড মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হচ্ছে। এতে হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীর চাহিদা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগানো এবং বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য কেন প্রয়োজন: বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কিন্তু কভিড মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা ও বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য হ্রাসসহ নানা কারণে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার। ফলে একক বাজারেরও পরনির্ভরশীলতা কমাতে এবং নতুন বাজারে প্রবেশ বাড়াতে মধ্য এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে সরকার। একজন অদক্ষ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যে আয় করতে পারেন, তার প্রায় ১০ গুণ বেশি আয় সম্ভব যদি দক্ষ শ্রমিকের বাজারে প্রবেশ করা যায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, একজন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক যেখানে মাসে আয় করেন ২০৩ ইউএস ডলার, সেখানে একজন ফিলিপাইনের দক্ষ শ্রমিক আয় করেন ৫৬৪ ইউএস ডলার। এমনকি একজন পাকিস্তানি শ্রমিকের আয় ২৭৬ ইউএস ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশের ১৩ মিলিয়ন শ্রমিক যেখানে দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স অর্জন করেছে, সেখানে ফিলিপাইন আরও কম শ্রমিক পাঠিয়ে একই বছরে তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলার আয় করে। প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধান এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে ২০২৪ সালের মধ্যে ৫০ লাখ দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় গন্তব্য হতে পারে জাপানি জনশক্তির বাজার।

জাপান কেন সম্ভাবনাময় বাজার: জাপানের সরকারি থিংক ট্যাংক গ্রুপের অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে সরকার ঘোষিত অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশটিতে প্রায় ৬৭ লাখ ৪০ হাজারের অভিবাসী কর্মীর প্রয়োজন হবে। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাপানের এই বিপুল জনশক্তির বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের দ্রুত প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে জাপানে প্রায় ১৭ লাখ ২০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। দেশটির অধিকাংশ কর্মী আসে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে। তবে উল্লিখিত দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে ভবিষ্যতে কর্মী আকৃষ্ট করতে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে জাপান। সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালে জাপানের প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তির প্রায় ২৮ শতাংশের জোগান আসবে ভিয়েতনাম থেকে। এছাড়া জাপান সরকার অন্যান্য দেশ, যেমনÑবাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার থেকেও কর্মী নিতে আগ্রহী। এ বিশাল সম্ভাবনাময় জনশক্তির বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরিতে দ্রুত ও পরিকল্পিত প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানে পাঠাতে হবে কারিগরি ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ শ্রমিক। অদক্ষ শ্রমিকনির্ভর বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে দক্ষ শ্রমিকের বাজারে পরিণত করতে দেশের শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার তরুণদের প্রশিক্ষণের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

জাপানি শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ। ২০১৯ সালে দেশটিতে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও জাপান। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ১৪টি নির্দিষ্ট খাতে পাঁচ বছরে সাড়ে তিন লাখ বিশেষায়িত দক্ষ কর্মী নেবে জাপান। খাতগুলো হলোÑনার্সিং, রেস্টুরেন্ট, বিল্ডিং ক্লিনিং, কৃষি, খাবার ও পানীয় শিল্প, সেবা, ম্যাটারিয়ালস প্রসেসিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণশিল্প, মৎস্য, অটোমেটিং যন্ত্রাংশ তৈরি ও এয়ারপোর্ট গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অ্যান্ড এয়ারক্রাফট মেনটেন্যান্স। বাংলাদেশ ছাড়াও আরও আটটি দেশের (থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন) সঙ্গে এ চুক্তি করেছে জাপান। ফলে সঠিক ও দ্রুত প্রস্তুতি না নিলে খুব সহজেই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কাছে বাজার হারাবে বাংলাদেশ।

অন্য দেশের তুলনায় জাপানে আয়ের সুযোগও বেশি। জাপানে একজন দক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন পৌনে দুই লাখ টাকা এবং কর্মীদের খরচও বহন করে জাপানি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি বিদেশি কর্মী আকৃষ্ট করতে দুই ধরনের ভিসাও চালু করেছে জাপান সরকার, যেখানে পেশাগত ও ভাষায় দক্ষতা থাকলে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিবারসহ স্থায়ী বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য জাপানের জনশক্তির বাজার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

জাপানের মানুষের গড় আয়ু বেশি এবং জš§হার কম হওয়ায় দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পেয়ে বেড়েছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। এতে অধিক বয়সী মানুষের সেবার জন্য কেয়ারগিভারের প্রয়োজন বাড়ছে দেশটিতে। ফলে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক পাঠানোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজার হতে পারে জাপান। কভিড মহামারির কারণে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। এসব শ্রমিক এরই মধ্যে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। জাপানের শ্রমনীতি, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করে এই জনগোষ্ঠীকে সহজেই এ বাজারে প্রবেশ করানো যাবে। এছাড়া জাপানের জনশক্তির বাজারে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো গেলে জি-৭ ভুক্ত অন্যান্য দেশ, যেমন ইতালি, জার্মানি, কানাডা ও ফ্রান্সেও বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের গুরুত্ব বাড়বে এবং নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ সহজতর হবে। উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে জাপানি ভাষা ও প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। জাপানের আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ উন্নয়ন সংস্থা (এমআই জাপান) এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।

মনে রাখতে হবে, ভিয়েতনাম যেখানে দক্ষ নার্স এবং ভারত আইটিনির্ভর জনশক্তি তৈরি করছে, বাংলাদেশেরও প্রয়োজন চাহিদাসম্পন্ন নির্দিষ্ট খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মনোযোগ দেয়া। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার আধুনিকীকরণ, সরকারি-বেসরকারি খাতের উপযুক্ত সমন্বয় ও সফল কূটনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি কোনো অসাধু গোষ্ঠীর কারণে জাপানের শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কেবল সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতির অভাবে বিপুল সম্ভাবনাময় জাপানের জনশক্তির বাজার হাতছাড়া হলে বিষয়টি হবে দেশের অর্থনীতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.