‘কিছু শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ঐচ্ছিক মনে করেন’

রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক, আর তা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি আমার আহ্বান আপনারা শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন, যাতে তাদের এ জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে না হয়। আপনারা তরুণ গবেষকদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসুন।

শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বক্তব্য দেন। এবারের সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন নোবেল বিজয়ী ফরাসী অর্থনীতিবিদ Professor Dr. Jean Tirole। তাঁকে সম্মানসূচক Doctor of Laws (Honoris Causa) ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো এক একটি গবেষণাগার। আর মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে মানসম্পন্ন গবেষণা ও গবেষণালব্ধ কাজের প্রয়োগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমেই সাফল্য লাভ করেছে। যুগের সাথে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমাদের জীবনযাত্রা গতিশীল হলেও দুঃখের বিষয় হলো গবেষণায় আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

তিনি আরো বলেন, এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হতো। সময়ের বিবর্তনে ক্রমেই যেন সেই ঐতিহ্য সংকুচিত হয়ে আসছে। অথচ ছাত্র শিক্ষক, ভৌত অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত না হলেও কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় শিক্ষার গুণগত মান এবং গবেষণার ক্ষেত্র, পরিমাণ ও মান কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে। গবেষণার বিষয়ে গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রচারিত হয় তা দেখলে বা শুনলে অনেক সময় আচার্য হিসেবে আমাকেও লজ্জায় পড়তে হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আপনারা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম এবং এর অনেক পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও শিক্ষকদের দেখলে বা তাঁদের কথা শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। কিন্তু ইদানিং কিছু কিছু উপাচার্য ও শিক্ষকদের কর্মকাণ্ডে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আপনাদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই কিছুসংখ্যক অসাধু লোকের কর্মকাণ্ডের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তিনি আরো বলেন, একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, পরিচালন, মূল্যায়ন ও উন্নয়নকে ঘিরে। কিন্তু ইদানিং পত্রিকা খুললেই মনে হয় পরিবার-পরিজন ও অনুগতদের চাকরি দেওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রশাসনিক ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই যেন কিছু উপাচার্যের মূল দায়িত্ব। আবার অনেক শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাকে ঐচ্ছিক দায়িত্ব মনে করেন। বৈকালিক কোর্স বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়াকেই তারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের সাথে এটি খুবই বেমানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই কৃতি ও সেরা ছাত্র ছিলেন। আমার বিশ্বাস আপনারা যেকোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হতেন। কিন্তু জীবনের মহান ব্রত হিসেবে শিক্ষকতাকেই আপনারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই শিক্ষক হিসাবে নিজ পেশার প্রতি দায়িত্বশীল থাকবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।

শিক্ষকসহ যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে উল্লেখ কর তিনি বলেন, ‘আমরা চাই উপাচার্যের নেতৃত্বে ও ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হোক অর্থাৎ Centre of Excellence হিসেবে গড়ে উঠুক। শিক্ষকগণ হয়ে উঠুন সমাজে মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে হয়রানি বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আহবান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তি আর আধুনিকতায় অনেক এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কর্মঠ আর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগেও প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে, ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট উত্তোলন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ছাত্র-ছাত্রীরা অবহেলা আর হয়রানির মুখোমুখি হন। আমি শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে One Stop Service Center; Counselling and Support Center; Career Planning Unit ইত্যাদি চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।’

গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তোমাদের শিক্ষার্জন যেন সমাবর্তন আর সার্টিফিকেটেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তোমাদের আজকের এই অর্জনের পেছনে বাবা-মা, শিক্ষকমণ্ডলী এবং রাষ্ট্রের যে অবদান ও ত্যাগ রয়েছে, তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.