কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মরণোত্তর ভাইস চ্যান্সেলর

এম এ মোমেন
২৪ নভেম্বর, ২০১৯

একজন ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) মারা গেলেন। মরণোত্তর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে স্বর্গের দরজার সামনে ইনভেস্টিগেশন সেলে ঢোকানো হলো।

ধর্মরাজ তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘পৃথিবীতে যখন ছিলে সর্বশেষ কী কাজ করতে?’

‘আমি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম। এক টার্মই।’

ধর্মরাজ বললেন, ‘তাহলে তো বাপু তোমাকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে, অনেক ভোগান্তি হয়েছে তোমার। তাহলে তোমাকে একটা ব্রেক দেওয়া দরকার।’

ধর্মরাজ তাঁর সহকারীকে ডেকে বললেন, ‘বেহেশতে পাঠিয়ে দাও।’

আরো একজন ভাইস চ্যান্সেলর মরণোত্তর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, ‘ধর্মরাজ, আমি ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম টার্ম শেষ হওয়ার পর আরো এক টার্ম পেয়েছি।’

ধর্মরাজ সহকারীকে ডেকে বললেন, ‘এক্ষুনি দোজখে পাঠিয়ে দাও। তার সমস্যা হবে না। দোজখ যন্ত্রণায় আগে থেকেই অভ্যস্ত।’ ধর্মরাজের এ কী অবিচার!

ফিসফিস করে ভাইস চ্যান্সেলর এ কথা বলতেই ধর্মরাজের সহকারী ঠোঁটের ওপর আঙুল ফেলে ফিসফিস করে বললেন, ‘ও কথা বলতে নেই। ধর্মরাজ অবিচার করেন না।’ যাদের উদ্ধার করার জন্য ভাইস চ্যান্সেলর ঘাড় পেতে দিয়েছিলেন তাদের সবাই সেই ঘাড়ে পা রেখে স্বর্গে চলে গেছে। ভিসি কোটায় স্বর্গে আর জায়গা নেই। তা ছাড়া ধর্মরাজ তো ঠিকই বলেছেন, ‘সেকেন্ড টার্ম যখন করতে পারছ, দোজখ যন্ত্রণা তোমার তো সয়েই গেছে।’

দোজখ যন্ত্রণা কেমন?

ভিসির প্রশ্নের জবাবে ধর্মরাজের সহকারী বললেন, ‘র‌্যাগিংয়ের যন্ত্রণার চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়, ওখানেও বড় ভাইরা আছেন, যাঁরা আগে এসেছেন চড়-থাপ্পড় মারার অধিকার তো তাঁদের থাকারই কথা।’

ভিসি বললেন, ‘কিন্তু র‌্যাগিং তো নতুন আগত ছাত্রদের বিষয়, আমি তো আফটারঅল ভাইস চ্যান্সেলর।’

ধর্মরাজের সহকারী বললেন, ‘তা ঠিক, কিন্তু তুমিই তো পৃথিবীর একজন ভাইস চ্যান্সেলর নও। তুমি নবাগত। বিভিন্ন দেশের দলবাজ ভিসি যাঁরা আগে এসেছেন, নতুনজনকে নিয়ে একটুখানি র‌্যাগিং করতে তাঁদেরও মন চায়।’ ধর্মরাজের গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, এত বাহাস কিসের?

সক্রেটিস কি বাংলাদেশে ভিসি হতে পারতেন?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও তাঁর ছিল না। সুতরাং সাফ জবাব, পারতেন না। কারণগুলো কী কী?

১. মেহনত করেই হোক, কি প্লেজারিজমের মাধ্যমেই হোক, কি প্রতিবেশী কোনো দেশের দুই নম্বরি প্রতিষ্ঠানের অনারারি ডিগ্রিই হোক—কোনো কিসিমের পিএইচডিই তাঁর নেই।

২. ভালো জার্নালেই হোক, কি রদ্দিমার্কা ভুসিমাল জার্নালেই হোক, তাঁর কোনো প্রকাশনা নেই।

৩. তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে যাওয়ার আগেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন : আমি কিছুই জানি না। বিশ্বাস না হয় তারই শিষ্য প্লেটোর লেখা পড়ে দেখুন—সক্রেটিস বলছেন, আই নো দ্যাট আই নো নাথিং।

৪. শিষ্যদের সঙ্গে গপসপ করে বড় একটা সময় নষ্ট করেন। এমনকি নিজের ঘরের দরজায়ও তাঁদের নিয়ে বকবক করেন। অনেকক্ষণ বকবক করায় তাঁর স্ত্রী যখন তাঁর মাথায় গামলা ভর্তি পানি ঢেলে দেন, তিনি শিষ্যদের শেখান—গর্জনের পরই বর্ষণ হয়। ভিসির স্ত্রীর এ ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় বলে সক্রেটিক প্রাইমারি সিলেকশনেই বাদ পড়ে যাবেন।

৫. তিনি যথাযথ পোশাক পরেন না, স্যুট তো নয়ই। বিছানার চাদরজাতীয় একটা কাপড় গায়ে পেঁচান, জুতা পরেন না।

৭. তিনি পণ্ডিত বটেন! কিন্তু তাঁর কোনো কারিকুলাম নেই, কোনো পরীক্ষা নেই। অতএব প্রশ্ন আউট হওয়ার সুযোগও নেই।

৮. যে কেউ তাঁর ক্লাসে ঢুকতে পারে, বিনে পয়সায় পড়ান। বিনে পয়সার জিনিসের যে গুরুত্ব নেই, তিনি এটিও বোঝেন না। শুধু তা-ই নয়, যে শিক্ষকরা পড়িয়ে পয়সা আদায় করেন, তিনি তাঁদের গালমন্দ করেন। তিনি তাঁদের বলেন ইম্মরাল সোফিস্ট।

৯. মাস্টারির ও প্রশাসন চালানোর বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

১০. কম বয়সী ছেলেদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান, ঘটনা কী?

১১. অভিযোগ উঠেছে, যুবকদের বিপথে পরিচালিত করছেন।

১২. তাঁর খুশিমনে আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে।

১৩. তাঁর ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্রসংগঠন আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

১৪. তিনি আমাদের লোক কি না সন্দেহ আছে, আমাদের সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য আত্মহত্যা করে বসতে পারেন। জেনোইন আত্মহত্যা জেনেও বিরোধী দল বলে বেড়াবে ভাইস চ্যান্সেলরকে হত্যা করা হয়েছে।

সব শেষে শিষ্যদের রাজনীতি সচেতন হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনা প্রদান করতে ব্যর্থ হওয়ায় সক্রেটিসকে পুরোপুরি অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হলো। মরণোত্তর ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার শেষে মুখোশটিও তিনি হারালেন।

উপযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলর না পাওয়ায় ধর্মরাজ অনেক শর্ত শিথিল করে দিয়েছেন : পিএইচডি লাগবে না, প্রকাশনা লাগবে না, কারিকুলাম বুঝতে হবে না, বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স পড়তে হবে না। ক্লাস নিতে হবে না, প্রশাসন চালাতে হবে না, স্ত্রীর আচরণের কোনো প্রভাব পড়বে না। চূড়ান্ত শর্টলিস্টে ভিসি ক্যান্ডিডেট দুজন : সক্রেটিস এবং বাংলাদেশের একজন (নাম বলে তাঁকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাচ্ছি না)।

দুজনের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুধু একটিই ফ্লেক্সিবিলিটি টেস্ট—হাঁটু সোজা রেখে মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে তা নামিয়ে আনতে হবে। যারটা বেশি নামবে, তিনিই ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

প্রথম পরীক্ষা সক্রেটিসের—বেচারার মেরুদণ্ডে ও গর্দানের হাড়ে এমন জং ধরেছে যে তিনি মাথা নোয়াতেই পারলেন না।

বাংলাদেশি প্রার্থীকে কিছু বলার আগে ধর্মরাজ তাঁর পায়ে চুলের সুড়সুড়ি অনুভব করলেন, দেখলেন হাঁটু সোজা রেখে এই জিমন্যাস্ট তাঁর মাথা ধর্মরাজের পায়ের ওপর স্থাপন করেছেন। সন্তুষ্ট ধর্মরাজ তাঁর সহকারীকে বললেন, এক্ষুনি দোজখে পাঠাও, আমাদের ইউনিভার্সিটিটা তো ওখানেই।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.