ইসলামে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও ইবাদত

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

ইসলাম ফিতরাত অর্থাৎ স্বভাবসুলভ দ্বিন। মানুষের স্বভাবসুলভ চাহিদা ইসলামে স্বীকৃত। ইসলাম তা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে সুশৃঙ্খলভাবে পুরো করার নির্দেশনা দেয়। এর মাধ্যমে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদাও ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন—মানুষ অনুকরণপ্রিয়। তাকে খেতে হয়, পান করতে হয়, টয়লেট করতে হয়, ঘুমাতে হয়। এসব ছাড়াও মানুষের যৌনচাহিদা আছে। কোনোটিকেই ধর্ম বন্ধ করে দেয়নি; বরং এসবের সুশৃঙ্খল পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

অনুকরণ : মানুষ অনুকরণপ্রিয়। সবাই অনুকরণ করতে চায়। শিশুরা পিতা-মাতা ও সমাজের অনুকরণ করেই সব শেখে। খেলা দেখে দর্শকরা প্রিয় খেলোয়াড়ের অনুকরণ করে। নাটক, সিনেমা দেখে মানুষ প্রিয় তারকাদের অনুকরণ করে। তাদের মতো করে পোশাক তৈরি করে, চুল রাখে, এমনকি নিজেকে তাদের মতো করে সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। এটি মানুষের জন্য স্বাভাবিক বিষয়। মহান আল্লাহ মানুষের অনুকরণপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং অনুকরণের নমুনা হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রেরণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২১)

খানাপিনা : খানাপিনা অতি প্রয়োজনীয় মানবিক চাহিদা। খানাপিনা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। ইসলাম খেতে বারণ করেনি; বরং উৎসাহিত করেছে। তবে হালাল খেতে বলেছে। অপচয় করতে বারণ করেছে। নিয়ম-নীতি মেনে খেতে বলেছে। যেমন—

১. খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা।

২. ডান হাতে খাওয়া। (বুখারি, হাদিস: ৫১৬৭, তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৩)

৩. দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া। (তুহফাতুল ক্বারি ১০/৩৫৬)

৪. হাত ও আঙুল চেটে খাওয়া। (বুখারি, হাদিস: ৫২৪৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৯১৪)

৫. লুকমা তুলে খাওয়া। (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৫: ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৪০৩)

৬. হেলান দিয়ে না খাওয়া। (বুখারি, হাদিস: ৫১৯০; তিরমিজি, হাদিস: ১৯৮৬)

৭. খাবারের শেষে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলা—‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আতআমানা ওয়াছাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৪৫৮) ইত্যাদি।

পেশাব-পায়খানা : পেশাব-পায়খানাও অতি প্রয়োজনীয় মানবিক চাহিদা। পেশাব-পায়খানা আটকে রেখে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ জন্যই তো নবী (সা.) এক বেদুইনকে মসজিদে নববীতে পেশাব করে ফেলতে দেখেও গালি বা ধমক দেননি; বরং প্রজ্ঞার সঙ্গে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মসজিদ ইবাদতের স্থান। মসজিদকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, অপরিচ্ছন্ন করতে হয় না। এভাবে এ প্রয়োজন পুরো করারও নিয়ম-শৃঙ্খলা রয়েছে। যেমন—

১. টয়লেটে প্রবেশের সময় দোয়া পাঠ করা— ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল খুবসি ওয়াল খাবাইস।’ (বুখারি, হাদিস: ১৩৯)

২. বাম পা দিয়ে টয়লেটে প্রবেশ করা। (নাসায়ি, হাদিস: ১১১)

৩. বাম পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসা। (আসসুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি, হাদিস: ৪৬৬)

৪. মাথা ঢেকে রাখা। (আসসুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি, হাদিস: ৪৬৪)

৫. বাম হাতে পবিত্রতা অর্জন করা। (মুসনাদে আহমাদ: ২৬৩২৬)

৬. টয়লেট সেরে ডান পা দিয়ে বের হয়ে দোয়া পাঠ করা—‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আজহাবা আন্নির আজা ওয়া আফানি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯৭) ইত্যাদি।

ঘুম : ঘুম ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ঘুম শরীরের ক্লান্তি দূর করে, মনে প্রশান্তি আনে এবং কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে। ঠিকমতো ঘুম না হলে শরীর ও মন কোনোটাই ভালো থাকে না। ঘুমের স্বাভাবিক সময় হলো রাত। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা শারীরিক সুস্থতার জন্য অতি জরুরি। এটিই ইসলামের চাওয়া এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনের আমল। ঘুমানোর কয়েকটি সুন্নত ও আদব—

১. আল্লাহর নাম স্মরণ করে খাবারের বাসন-পত্র ঢেকে রাখা, ঘরের দরজা বন্ধ করা এবং বাতি নিভিয়ে ঘুমের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস : ৩১০৬)

২. হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানো। (আবু দাউদ, হাদিস: ৩৮৫৪)

অজু করে নেওয়া আরো উত্তম।

৩. বিছানা ঝেড়ে নেওয়া। (বুখারি, হাদিস: ৫৯৬১)

৪. ডান কাত হয়ে শোয়া। (বুখারি, হাদিস: ৫৯৫৬) ৫. ঘুমানোর দোয়া—‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’ পড়ে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস: ৬৯৬৫)

০৬. ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস: ৩১০) ৭. সুরক্ষার জন্য সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে দুই হাতে ফুঁ দিয়ে মাথা থেকে দেহ পর্যন্ত যত দূর হাত যায় বুলিয়ে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস: ৪৭২৯)

৮. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আহয়্যানা বাদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর’ পাঠ করা। (বুখারি, হাদিস: ৬৯৬৫)

যৌনাচার : সুশৃঙ্খল যৌন জীবনের জন্য ইসলাম বিয়েকে অনুমোদন দিয়েছে। পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, সংযত ও সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য বিয়ের বিকল্প নেই। বিয়ে মানসিক প্রশান্তি, স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল জীবনের অন্যতম মাধ্যম। বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে সখ্যতা, ভালোবাসা ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দর পৃথিবী গড়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য তাতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২১)

ইসলামে বিয়েবহির্ভূত যৌনাচারের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের স্ত্রী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীরা ছাড়া, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না এবং কেউ তাদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লঙ্ঘনকারী।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ৫-৭)

এভাবে মানুষ বলতে চায়, শুনতে চায়, দেখতে চায়, ভাবতে চায়, ধরতে চায়, চলতে চায় ইত্যাদি। সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নির্দেশনা আছে। তার আলোকেই সুশৃঙ্খল হয় মানবজীবন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.