আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি পোশাক কিনবে যুক্তরাষ্ট্র

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। কভিড পরিস্থিতিতেও গত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশটিতে পোশাক রফতানি বেড়েছে ১৩ শতাংশের বেশি। সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, অন্তত আগামী দুই বছর এ প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকবে। এ সময় বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয় বাড়িয়ে তুলতে যাচ্ছে মার্কিন খুচরা বিক্রেতা (রিটেইলার) প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব রিটেইলার প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটাসংশ্লিষ্ট শীর্ষ নির্বাহীরা জানিয়েছেন, মূলত বাংলাদেশী পোশাকের মূল্য সুবিধাকে কাজে লাগাতেই ক্রয় বাড়ানোর কথা ভাবছেন তারা।

ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শেং লুর তত্ত্বাবধানে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত তিন মাসব্যাপী এ জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। মার্কিন সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসএফআইএ) পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এ জরিপে পাওয়া তথ্য সম্প্রতি ‘২০২১ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে। মার্কিন ফ্যাশন পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পোশাক ক্রয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত (সোর্সিং এক্সিকিউটিভ) নির্বাহীদের ওপর জরিপটি চালানো হয়।

জরিপে অংশ নেয়া মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস এশিয়ার দেশগুলো। এর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। গত বছর মার্কিন রিটেইলারদের ৯৩ শতাংশই চীন থেকে পোশাকের সরবরাহ নিয়েছে। ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে নিয়েছে যথাক্রমে ৮৭ ও ৭৭ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে থাকা বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ নিয়েছে ৭৩ শতাংশ। জরিপে ৮৫ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, আগামী দুই বছর তারা এশিয়ার বেশ কয়েকটি উৎস দেশ থেকে পোশাক ক্রয় বাড়াবেন। বাংলাদেশ ছাড়াও তাদের এ আগ্রহের তালিকায় রয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া।

প্রশ্নোত্তরভিত্তিক এ জরিপে বিভিন্ন দেশের পোশাক শিল্প নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের মূল্যায়নও উঠে এসেছে। মার্কিন রিটেইলার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা মনে করছেন, বাংলাদেশী পোশাকের মার্কিন বাজারে পৌঁছার গতি এখনো বেশ দুর্বল রয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকি রয়ে গিয়েছে শিল্পটির সামাজিক ও শ্রম কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনায়ও। তবে পোশাকের সোর্সিং কস্ট বা উৎসমূল্য ও বাণিজ্য ব্যয় বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনো আকর্ষণীয়। মূলত এ কারণেই ঝুঁকি থাকলেও মার্কিন রিটেইলারদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে মূল্য সুবিধা পাওয়া যায় তুলনামূলক বেশি। তবে কভিড-পরবর্তী বিশ্বে পোশাক পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যের ঘাটতি বাংলাদেশী সরবরাহকারীদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠবে।

চলমান মহামারী ক্রেতাদের পণ্যের চাহিদায় পরিবর্তন এনেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ক্রেতাদের মধ্যে এখন মৌলিক পণ্যের চেয়ে সোয়েটার, স্মক ড্রেস, সোয়েটপ্যান্টের মতো পণ্যের চাহিদা বেশি। নতুন এসব পণ্যের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম অনেক বেশি সফল। এ অবস্থায় কভিড-পরবর্তী বিশ্বে মার্কিন ফ্যাশন কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করা বাংলাদেশী বিক্রেতাদের জন্য জটিল হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৮ শতাংশ বলেছেন, তারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয়ের উেস পরিবর্তন আনবেন না। বরং ভেন্ডরের সংখ্যা কমিয়ে আনবেন। ফলে বাংলাদেশী পোশাক সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হয়ে উঠবে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহে সক্ষম সরবরাহকারীরা এক্ষেত্রে সুবিধা পেলেও বিপাকে পড়বেন ক্ষুদ্র ও কম সক্ষমতার সরবরাহকারীরা।

জরিপে উঠে আসে, বাজারে পণ্য পৌঁছার গতি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হলেও সোর্সিং কস্ট বা পণ্য ক্রয় বাবদ ব্যয়ের দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। আবার সামাজিক ও কর্মপরিবেশের কমপ্লায়েন্সের দিক থেকে এখনো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এখন ভালো পণ্য তৈরি করছে। সেই পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এর পাশাপাশি মূল্য সুবিধার কারণেই অনেক ক্রেতা বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন। বাংলাদেশ সাপ্লাই চেইনেও বেশ উন্নতি করেছে। পণ্য বিপণন কৌশলে পরিবর্তন এলেও আরো উন্নতি করতে হবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের দক্ষতা অনেক বেড়েছে। বৈশ্বিকভাবে এখন স্বচ্ছতার বিশেষ গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেকসই পণ্য তৈরির পথেও হাঁটতে শুরু করেছে। এসব কারণেই মার্কিন ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে পণ্য ক্রয়ের আগ্রহ বেড়েছে।

দেশের পোশাক রফতানিকারক শিল্প-কারখানার মালিক সংগঠন প্রতিনিধিরা বলছেন, সামনের দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে এখান থেকে পোশাক সরবরাহ বাড়ার পূর্বাভাসটি যৌক্তিক ও স্বাভাবিক। বিকেএমইএর হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষেই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক সরবরাহে প্রবৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশও হতে পারে। যদিও সরকারি প্রক্ষেপণে তা ধরা হয়েছে ১৭ শতাংশের কিছু বেশি। তবে শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা এখন পণ্যে আরো বৈচিত্র্য আনার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। কারণ গোটা বিশ্বেই এখন কৃত্রিম তন্তু থেকে উৎপাদিত পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো শুধু মৌলিক পোশাক পণ্যের জায়গাটিতেই শক্তিশালী। তবে ধীরে হলেও এখন বৈচিত্র্য বৃদ্ধির সক্ষমতার উন্নয়ন হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মার্কিন ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের চাহিদা ক্রমেই আরো বাড়বে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশটিতে পোশাক পণ্যের রফতানি প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশেও দাঁড়াতে পারে। ফলে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশ থেকে পণ্য ক্রয় বাড়ানোয় মার্কিন ক্রেতাদের আগ্রহের বিষয়টি স্বাভাবিক। তবে ক্রয়াদেশ না বাড়িয়ে মার্কিন ক্রেতারা যদি ভেন্ডর কমিয়ে আনে তাহলে অনেক কারখানা বন্ধের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিকাশও ব্যাহত হবে।

পোশাক শিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) প্রতিনিধিরাও মার্কিন বাজারে চাহিদা বাড়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, কভিডের ধকল মোকাবেলা করে দেশটিতে আউটলেটগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোয় এর প্রতিফলন দেখা যাবে।

বিজিএমএইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, সারা বিশ্বেই ফ্যাব্রিকের গঠনে পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে যেখানে ৭০ শতাংশই কটন ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে সেখানে ৭০ শতাংশ কৃত্রিম তন্তু ব্যবহূত হচ্ছে। কটন আর কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করে একটি টি-শার্ট বানাতে একই সময় লাগে। কিন্তু কৃত্রিম তন্তুর ক্ষেত্রে দাম বেশি পাওয়া যায়। এতে রফতানি মূল্য বেড়ে যায় ২০-৩০ শতাংশ। এক্ষেত্রে নতুন করে কারখানা করার প্রয়োজন নেই। শুধু কিছু উন্নত মানের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। সরকার যদি এ ধরনের ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে রফতানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে, তাহলে সবাই এতে এগিয়ে আসবে। ভিয়েতনাম এগুলো ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও সেদিকেই যেতে হবে।

দেশের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার সিংহভাগের জোগানদাতা রফতানি খাত। এ রফতানির ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যেই দেশের রফতানি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসবে। ওই সময়েই প্রথম প্রাক-কভিড পর্যায়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে দেশের রফতানি। সেক্ষেত্রে আগামী বছর রফতানির পরিমাণ ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.